ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ডিসেম্বর গেলে আর কেউ খোঁজ নেন না

রেজাউল করিম বিপুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৫
ডিসেম্বর গেলে আর কেউ খোঁজ নেন না ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফরিদপুর: ‘ডিসেম্বর মাস এলেই অনেকে আসেন, খোঁজ-খবরও নেন। কিন্তু ডিসেম্বর মাস চলে গেলে সারা বছরে আর কেউ খোঁজ নেন না’- এ অভিযোগ শহীদ ল্যান্সনায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের বড় বোন জোহরা বেগমের।



একমাত্র ভাই মুন্সী আব্দুর রউফের বাড়ি সম্পর্কে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘বীরের বাড়ি পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায় কেউ তার দিকে একটু খেয়াল করে না। একটি জাদুঘর বানায় দিছে, তাতে আসার রাস্তা নাই, বিদ্যুৎও নাই, এমনই অবস্থা’।   

তিনি বলেন, ‘বীরের সম্মানে কেন এই সালামতপুর (বর্তমানে রউফনগর) গ্রামে বিদ্যুৎ আসবে না। কেন এ গ্রামের বীরের জন্য সরকারের করা জাদুঘরে যাওয়ার রাস্তা হবে না। এগুলো দ্রুত করতে হবে, এটাই দাবি’।

তবে নিজের সম্পর্কে জোহরা বলেন, ‘আছি ভালোই। সরকার যেটুকু খোঁজ-খবর রাখে, তাতে ভালোই চলে যাচ্ছে’।

শহীদ ল্যান্সনায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ০৮ এপ্রিল রাঙ্গামাটির মহালছড়িতে পাকিস্তানি হানাদারদের ছোড়া মর্টারের গোলায় বাংলা মায়ের এই বীর সন্তান শাহাদাৎ বরণ করেন।

ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ তার কোম্পানির মেশিনগানার হিসেবে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি বুড়িঘাটা নৌ-পথে গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে দায়িত্বরত ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদারদের মর্টার ও ভারী অস্ত্রের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মুখে সেদিন মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।

এ অবস্থায় তার সঙ্গী যোদ্ধারা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান এদিক-সেদিক। ওই ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতির মুখেও একমাত্র ল্যান্সনায়েক রউফ তার নিজের অবস্থানে থেকে মেশিনগানের মূহুর্মূহু ব্রাসফায়ারে শত্রুদের পাল্টা জবাব দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদারদের দু’টি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট পানিতে ডুবে যায় এবং দুই প্লাটুন শত্রু সৈন্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
 
এ সময় হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা তাকে আঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পরে রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার চিংড়িখালের পাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়।

মধুখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, নানিয়ারচর থেকে তার সমাধিস্থলটি তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসার। কারণ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা সমরেন্দ্র নাথ বসু ও আকরাম খান বলেন, বিশেষ দিনগুলোতে তাকে স্মরণ করতেও সুদূর রাঙ্গামাটিতে ফরিদপুরের তার স্বজন বা কোনো মানুষ যেতে পারেন না। তাই তার সমাধিটি যেন ফরিদপুরের স্থানান্তর করা হয়।

এছাড়া রউফের নামে ফরিদপুর ও রাজাবাড়ীর সীমানায় এবং ফরিদপুর ও মাগুরার সীমানায় দু’টি স্থায়ী গেট করার দাবি জানান তারা। যাতে দেশের মানুষ যাতায়াতের পথে জানতে পারেন, এটি রউফের জেলা।
 
মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামারখালীর মধুমতি নদীর তীরের ছোট্ট গ্রাম সালামতপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে তার অদম্য সাহস, কর্তব্য পরায়ণতা, দৃঢ়সংকল্প দেশ প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে।
 
তার পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান। মাতা মকিদুননেছা। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রউফ ছিলেন সবার বড়। বাবা মেহেদী হাসান স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ছেলের লেখাপড়া বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি। ফলে কামারখালী হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ইপিআরে (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এ যোগ দেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

বিজয়ের মাসে তার নিজ গ্রাম ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার সালামতপুরের (বর্তমানে রউফনগর) মানুষের দাবি এখনো পূরণ হয়নি। মধুখালী উপজেলার মধুমতি নদীর কোল ঘেঁষে সামনের দিকে এগোলেই অবহেলিত এ জনপদ সালামতপুর গ্রাম।

একমাত্র কামারখালীতে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ডিগ্রি কলেজের নামকরণ করা ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তার নামে নামকরণ করা হয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

বীরমাতা বেঁচে থাকতে কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে কামারখালীকে বীরশ্রেষ্ঠের নামে আলাদা উপজেলা গঠনের দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী তা বিবেচনায় নেন। তবে তা এখনো তা কাগজপত্র চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।

এদিকে আধুনিক সভ্যতার যুগে এখনো বীরশ্রেষ্ঠের গ্রাম সালামতপুরে আজো পৌঁছেনি বিদ্যুৎ। একটি মাত্র কাঁচা রাস্তা, তাও মধুমতি গ্রাস করেছে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই নদীর পাড় দিয়ে ভাঙ্গা মারাত্মক রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন আশেপাশের ৫ গ্রামের মানুষ।

মধুখালীর কামারখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ লুৎফর রহমান বলেন, সালামতপুর গ্রামে সরকারিভাবে গড়ে তোলা বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ না থাকায় পাঠকরা আসছেন না। তিনি বলেন, পাঠাগারে যাতায়াতের রাস্তার একটি অংশ মধুমতি নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে।

সম্প্রতি সরকারি হওয়া বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মোঃ সাদিকুর রহমান জোয়াদ্দার বলেন, একটি জাদুঘর করা হয়েছে নামমাত্র। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই, বিদ্যুৎ নাই, এতে কোনো লাভ নেই। এছাড়া বাড়িটিও এখন বিরানভূমিতে রুপ নিয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডালিয়া মৌসুমী খান বলেন, মধুমতি নদীর ভাঙ্গনের ফলে জাদুঘরের যোগাযোগের রাস্তাটি বারবার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বিদ্যুতের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৫
আরকেবি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।