ঢাকা: রবি-এয়ারটেলের একীভূত করার প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানিতে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ, রবি-এয়ারটেল কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা, সুষ্ঠু তরঙ্গ ব্যবস্থাপনার ওপর মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা।
একীভূত (মার্জার) হলে বিশেষ করে গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়ে তারা বলেছেন, এক্ষেত্রে বিটিআরসিকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।
বেসরকারি এই দুই মোবাইল অপারেটর একীভূত করা নিয়ে বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রমনায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
বেলা ১১টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার এই গণশুনানিতে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), মোবাইল গ্রাহক, বিভিন্ন সরকারি/আধা সরকারি/স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা, টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-ছাত্র, গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, টেলিকম সেক্টরের প্রতিনিধিসহ ৯৮ জন অংশ নেন। তাদের মধ্যে বক্তব্য দেন ৩২ জন।
গণশুনানির শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, রবি-এয়ারটেল এক হলেও চাকরির ওপর প্রভাব পড়বে না। একীভূত হওয়া নিয়ে তাদের প্রথমে প্রশ্ন করেছি। তারা বলেছে, চাকরিতে প্রভাব পড়বে না।
বর্তমানে গ্রামীণফোনের ৪২ শতাংশ, বাংলালিংকের ২৫ শতাংশ, রবি’র ২১ শতাংশ, এয়ারটেলের ৮ শতাংশ, টেলিটকের ৩ শতাংশ ও সিটিসেলের ১ শতাংশ মার্কেট শেয়ার রয়েছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, দুই অপারেটর এক হলে তাদের মার্কেট শেয়ার দাঁড়াবে ২৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে নতুন হলেও বিদেশে মার্জার নতুন নয় বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান।
গুণশুনানিতে ক্যাব’র পক্ষে ব্যারিস্টার আনিক আর হক বলেন, দুই অপারেটর একীভূত হলে তাদের তরঙ্গ সবচেয়ে বেশি হবে। একীভূত হওয়ার পর দুই অপারেটরের তরঙ্গ একীভূত হবে কি-না, আইন অনুযায়ী তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, একীভূত হলেও দুই অপারেটরের কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। নিশ্চয়তা থাকলেও এক বছর পর যদি স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়ার স্কিম ঘোষণা করে, তাও জানাতে হবে।
দুই কোম্পানি একীভূত হলে গ্রাহক সেবার মান উন্নয়নে অপারেটরদের মনোযোগ নাও থাকতে পারে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, একীভূত হওয়ার পর বড় তিনটি অপারেটরের মার্কেট শেয়ার হবে ৯৬ শতাংশ। তিন অপারেটর মিলে বাজার দখল করায় গ্রাহকদের সেবার দিকে তারা মনোযোগ নাও দিতে পারে- আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই ক্যাব প্রতিনিধি।
মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সভাপতি আমিরুল ইসলাম বলেন, দু্ই অপারেটর এক হয়ে গেলে রিচার্জ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। চাকরির প্রভাব পড়তে পারে কিনা- সেটাও দেখতে হবে। তিনি এক হওয়ার আগেই রবি-এয়ারটেল মিলে প্রচারণা চালানোর বিষয়টি বিটিআরসি’র নজরে আনেন।
এ সময় বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, প্রচারণা চালানোর অনুমতি দেইনি। চাকরির ওপর প্রভাব পড়বে না, তারা নিশ্চয়তা দিয়েছে।
সিটিসেলের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন এমএনপি নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। না হলে সিটিসেলের মতো টেলিটকেরও একই অবস্থা হবে। অন্য অপারেটররাও বাজারে আসতে চাইবে না। তরঙ্গ নিলামে আইপিইউ’র নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
রবি'র পিপল অ্যান্ড কর্পোরেট বিভাগের টেকনিক্যাল রেগুলেশনস'র ভাইস প্রেসিডেন্ট অনামিকা ভক্ত বলেন, এক হলে নেটওয়ার্ক কভারেজ বেড়ে যাবে, কভারেজ বাড়লে কাস্টমাররাও বেশি সুবিধা পাবেন। কাস্টমরারা যেন হ্যারাজ না হন, সেজন্য নতুনভাবে আর এয়ারটেলের কোড (০১৬) দেওয়া হবে না।
গ্রামীণফোনের ইকোনমিক অ্যানালিস্ট শামীম শাহানী বলেন, সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় মাধ্যম হল তরঙ্গ। একীভূত হওয়ার আগে তরঙ্গ নিলামের বিষয়টি নিশ্চিত করারও অনুরোধ জানান তিনি।
আইনজীবী ইউসুফ আলী বলেন, এক হলে তিনটি অপারেটরদের হাতে ৯৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার চলে গেলে নতুন কোনো বিনিয়োগ হবে না। এর ফলে গ্রাহকদের জন্য ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। বাজার প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তজার্তিক সংস্থা দিয়ে সমীক্ষা করা উচিত। যে দু’টি সংস্থা দিয়ে সমীক্ষা করা হচ্ছে, তাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
গণশুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের যেন কোনোভাবে ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি দেখার আহ্বান জানানো হয়। গ্রাহকদের মধ্যে শিব্বির আহমেদ বলেন, এয়ারটেল অন্যান্য দেশে কাজ করলে এদেশে কাজ করতে পারছে না কেন? মার্জ হলে মনোপলি ব্যবসা করে যাবে। দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
মার্জ না হলে কী হবে- সেটাও জানতে চান একজন। বড় ধরনের শুনানির আয়োজন করার মত দেন আরেকজন।
টেলিটকের প্রতিনিধি রনক আহসান এয়ারটেলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিটিআরসিতে ১০টি অভিযোগ দিয়েছেন জানিয়ে বলেন, এর একটিরও সুরাহা হয়নি। তার মতো অনেক গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন।
রবি’র মার্কেটিং ম্যানেজার দিদারুল আলম বলেন, এক হলে গ্রাহকরা বেটার কোয়ালিটি সার্ভিস পাবেন। অন্য অপারেটররা বাধ্য হয়ে তরঙ্গ নিলামে অংশ নেবে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে।
গ্রাহক ও ভোক্তাদের প্রত্যেকটি কনসার্ন নজরে আনা হবে জানিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, চারটি নির্দিষ্ট বিষয় মাথায় রেখে এগোচ্ছি।
তিনি বলেন, সমীক্ষার জন্য দু’টি কমিটি করা হয়েছে, তারা সামাজিক ও কারিগরি প্রভাব বিশ্লেষণ করবে। চার অপারেটরের মতামত নিয়েছি। গণশুনানির এ আয়োজন এবং বিটিআরসি’র উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি মতামত দেবে। এরপর মন্ত্রণালয় মতামত দিলে এগোবো।
মার্জারের আগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ, টাকা-পয়সা আটকে আছে কি-না, সেগুলো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন আদালত।
একীভূতের জন্য ই-মেইলে ১০০টির মতো মতামত এসেছে জানিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, এখনও মতামত জানানো যাবে।
কারিগরি ও আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে দুই কমিট বেস্ট প্রাকটিস অনুসরণ করে মতামত দেবে বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান।
বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবিব খান, গণশুনানির সদস্য বিটিআরসি কমিশনার (এসএম) এটিএম মনিরুল ইসলাম ও কমিশনার (এলএল) মো. জহিরুল ইসলামসহ কমিশনের অন্যান্য কমিশনার ও ঊর্ধতন কর্মকর্তারা গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
রবি-এয়ারটেল একীভূত করতে গত ২৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আনুষ্ঠানিক চুক্তির পর রবি আজিয়াটা লিমিটেড জানিয়েছে, একীভূত কোম্পানি রবি নামেই ব্যবসা পরিচালনা করবে।
রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার বিষয়ে গত ০৮ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসিতে দেশের অপর চার অপারেটর ইতিবাচক মত দেয়।
রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার প্রভাব বিশ্লেষণে বাজার সমীক্ষারও উদ্যেগ নিয়েছে বিটিআরসি।
এক হওয়া নিয়ে রবি-এয়ারটেলের চুক্তি সম্পাদনের ফলে শেয়ার মূলধনের পুনর্বিন্যাস করা হবে। এতে আজিয়াটা ৬৮ দশমিক ৭ শতাংশ ও ভারতী ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। বাকি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বর্তমানের অপর শেয়ারহোল্ডার জাপানের এনটিটি ডকোমোর কাছে থাকবে।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে চুক্তির পর চুক্তির কার্যকারিতা বিটিআরসি, সরকার এবং আদালতের অনুমোদন পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল বলে উল্লেখ করে এর আগে যৌথ ঘোষণায় দুই অপারেটর জানায়, এ প্রক্রিয়া আগামী দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
দুই কোম্পানি এক হলে তাদের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় চার কোটি, যা বাংলাদেশের মোট মোবাইল ফোন গ্রাহকের এক-চতুর্থাংশ। বর্তমানে পাঁচ কোটির বেশি গ্রাহক নিয়ে গ্রামীণফোন সবার শীর্ষে রয়েছে।
বিটিআরসি’র হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশে মোট মোবাইল ফোন গ্রাহক সংখ্যা ১৩ কোটি ৩৭ লাখ। এ সময়ে অপারেটর রবির গ্রাহক সংখ্যা দুই কোটি ৮৩ লাখ এবং এয়ারটেলের এক কোটি ৭১ হাজার।
বাংলাদেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম একীভূত করার সম্ভাবনার বিষয়ে গত বছরের ০৯ সেপ্টেম্বর আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেয় দুই কোম্পানি। রবির মালিকানা মালয়েশিয়াভিত্তিক আজিয়াটা গ্রুপের। অন্যদিকে এয়ারটেলের মালিক ভারতের ভারতি এয়ারটেল। এর আগে তারা ওয়ারিদের ব্যবসা বাংলাদেশে কিনে নিয়েছিল।
এশিয়ার বড় টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলোর মধ্যে আজিয়াটা অন্যতম। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পাশাপাশি কম্বোডিয়া, ভারত ও সিঙ্গাপুরেও তাদের ব্যবসা রয়েছে।
** রবি-এয়ারটেল একীভূত করা নিয়ে গণশুনানি শেষ
** রবি-এয়ারটেল একীভূত করা নিয়ে গণশুনানি চলছে
বাংলাদেশ সময়: ১৬০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
এমআইএইচ/এএসআর