ঢাকা: বিচার বিভাগ নিয়ে কটাক্ষ না করতে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান বিচারপিত বলেন, ‘দেশকে যদি বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র যদি বিশ্বাস করি, বিচার বিভাগকে মানতে হবে। বিচার বিভাগের মান যাতে অক্ষুন্ন থাকে- এটা আমি সবাইকে আবেদন জানাচ্ছি’।
বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে খুবই কষ্ট পেতে হয়, যখন বিচার বিভাগ নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের লোক কথা বলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধান এটাকে মার্শাল ল’ পিরিয়ডে কয়েকবার ছিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে। এ বিচার বিভাগই সংবিধানকে আগের জায়গায় নিয়ে আসছে।
আজকে অনেকে (যেকোনো রাজনৈতিক দল) কথা বলে। তারা মামলায় জড়িত হতে পারে, কিন্তু আমরা বিচার বিভাগ কোনো দিন পক্ষপাতিত্ব করিনি। আমরা জামিন দিয়েছি। এরপরও কিন্তু আমাদের কটাক্ষ করা হয়। খুবই কষ্ট পেতে হয় এসব কথা শুনে’।
আইনজীবীদের নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘শওকত আলী যখন ছিলেন, আপনারা বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। কিন্তু তার রাজনীতি আইন পেশার মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি। এখনকার দিনে আমরা যে বার (আইনজীবী সমিতি)পাই সেটা শার্পলি ডিভাইডেড। যখনি কোনো ইস্যু হয়, তখন কিন্তু আইনজীবীরা বিচার বিভাগকে কটাক্ষ করতে, সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এটা খুব কষ্ট লাগে। অনেক পরীক্ষার পর আজকে এই পর্যায়ে চলে আসছে। দেশে অনেকগুলো মার্শাল ল’ আসছে। সাময়িকভাবে বিচার বিভাগকে একটু স্তিমিত করা গেছে, কিন্তু বিচার বিভাগ আবার স্বরুপে দাঁড়িয়েছে’।
‘আমি আশা রাখবো, আপনারা যারা রাজনীতি করেন, তারা রাজনীতি করেন, কিন্তু এ বিচার বিভাগকে কটাক্ষ করে কোনো বক্তব্য দেবেন না’ বলেও মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।
তিনি বলেন, ‘এ বিচার বিভাগ এতো স্ট্রং, আমি বলবো, আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আপনারা যতোই সমালোচনা করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনো দিনই ক্ষুন্ন হবে না। যেমন আমরা সমুদ্রে বিষ ঢেলে দেই, তাহলেও সমুদ্রের পানি নষ্ট হবে না’।
সংবাদ মাধ্যমের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন,‘আজকে সংবাদ মাধ্যমগুলো এটা কিন্তু কোনো ব্যবসা না। সংবাদ মাধ্যমে যারা কাজ করেন, এটা একটা পেশা। আমরা কিন্তু এখন সংবাদ মাধ্যমকে দেখে যাচ্ছি এটা একটা ব্যবসা হিসেবে তারা ….. করছে। এটা খুবই দুঃখজনক। সংবাদ মাধ্যম যে পেশা সেটার দু’টি উদাহরণ দিয়ে আমি বক্তব্য শেষ করবো’।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সফল প্রেসিডেন্ট ছিলেন রুজভেল্ট। আমরা কেউ জানি না, তিনি পোলিও রোগী ছিলেন। তিনি যতোদিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন
আমেরিকার কোনো সংবাদ মিডিয়া (হাঁটার সময় তিনি ক্র্যাচ অথবা একজনের সহযোগিতা ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না) কোনো সংবাদ মাধ্যম তার ছবি প্রকাশ করে নাই’।
‘আরেকজন রাজনীতিকের কথা বলছি, তিনি ব্রাউন। উইলসন যখন লন্ডনের প্রধান বিচারপতি ছিলেন ব্রাউন ছিলেন ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার। ব্রাউনের দুর্বলতা ছিল, তিনি হার্ড লিকার বেশি পরিমাণে খেতেন। একদিন তিনি পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছেন। তখন উইলসন পার্লামেন্টে ঢুকছেন। ব্রাউন এতোভাবে ড্রিংক করে ফেলছেন যে, বের হওয়ার সময় উইলসনের সামনে তিনি পড়ে গেলেন। উইলসন হাত ধরে তাকে গাড়িতে তুলে দিলেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ঢুকছেন, সেখানে অনেক সংবাদকর্মী ছিলেন। ব্রাউনের ছবি তোলা হল, কিন্তু প্রকাশ করা হল না। তিনদিন পরে টাইম ম্যাগাজিনে সম্পাদকীয়তে লেখা হল। বলা হল আমরা নৈতিকতার জন্য এটি সংবাদ প্রকাশ করিনি’।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজকে আমরা এই নৈতিকতা দুই দেশের নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে ধরলাম। আজকে আমার দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো..আমাদের
খুবই কষ্ট লাগে যে, এই বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অঙ্গের মধ্যে একটি। তাদের ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ করার জন্য তারা কোনোদিনই পিছপা হন না, এই বিচার বিভাগকে একেবারেই এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। এখন আমার প্রশ্ন হল, আমরা যদি এই বিচার বিভাগ দেশের জনগণের বিচার করতে গিয়ে আজকে যদি সংবাদপত্র এবং এই সংবাদপত্রের কর্মী যাদের তাদের পিছনে তাদের যদি কনটেম্পট প্রসেডিং বা এইগুলো যদি সময় নষ্ট করি, তাহলে লাখ লাখ মামলা, এগুলো আমরা কিভাবে নিষ্পত্তি করবো?’
স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার। বক্তব্য দেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ন, সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহমেদ ও শ ম রেজাউল করিম।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
ইএস/এএসআর