ঢাকা: ঋতুরাজ বসন্ত বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে নতুন পাতায় গাছগুলো সজ্জিত হতে শুরু করেছে।
বসন্তের মাসে মাঠে শোভা পাচ্ছে বোরো ধানের সুবজ চারা, কিছুদিন পর থেকেই গমে লাগবে হলুদ রঙের ছোয়া, ভুট্টা তোলারও সময় প্রায় এগিয়ে এসেছে, আমের মুকুল বড় হচ্ছে, পাট বপনের সময়ও উঁকি দিচ্ছে। রবি শস্যের অন্যান্য ফসলও ঘরে তোলার প্রস্তুতি নেবেন কৃষকরা।
তাই এসব কৃষি ফসলের যত্নে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে সেজন্য বোরো ধানসহ রবি শস্যের পরিচর্যার নানা দিক নির্দেশনা তুলে ধরা হলো।
বোরো ধান: বোরো ধানের চারার বয়স ৫০ থেকে ৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরি প্রয়োগ করতে হবে। জমি থেকে পানি সরানোর পাশাপাশি আগাছা পরিষ্কার করে এ সার দিতে হবে। জমিতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে না।
ধানের কাঁইচ থোঁড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত জমিতে তিন থেকে চার ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত খেত পরিদর্শন এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, খেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধান খেত বালাই মুক্ত রাখতে হবে।
এ সময় ধান খেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যেকোনো কৃমিনাশক যেমন ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করা যেতে পারে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। এবং হেক্টরপ্রতি ৪০০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা নেটিভ ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।
জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি হারে পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে সাত থেকে দশদিন পর আবার সেচ দিতে হবে। টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং দমন করতে হবে।
গম: গমের শিষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। মাঠে অবস্থিত গম ফসল বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে কাটার আগে মাঠে যে জাত আছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সঙ্গে তুলে ফেলতে হবে। নয়তো ফসল কাটার পর বিজাত মিশ্রণ হতে পারে।
সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত। বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই-ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি): জমিতে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার ওপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে আবার অনেকে টিনের চালে বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করে থাকেন। তবে যেভাবেই শুকানো হোক না কেন বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
ভুট্টার দানা মোচা থেকে ছাড়ানো অনেক কষ্টের কাজ। খুব অল্প খরচে ভুট্টা মাড়াইযন্ত্র কিনে অনায়াসে মোচা থেকে ভুট্টা ছাড়াতে পারেন।
ভুট্টা (খরিফ): খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।
পাট: ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪। স্থানীয় বীজ ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করা যেতে পারে।
পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে পাঁচ থেকে ছয়টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়।
পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার রাখা ভালো। আর ভালো ফলনের জন্য শতাংশ প্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেওয়ার সময় ৪০০ গ্রাম জিপসাম ও ২০ গ্রাম দস্তা সার দিতে হবে। চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
শাকসবজি: এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দেওয়া যেতে পারে।
সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজি খেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।
আমের মুকুল: এ সময়ে আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কাঁঠালের যত্ন: কাঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। এ রোগের হাত থেকে মুচি বাঁচাতে হলে কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে।
মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার রোদে মিশ্রণ বা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফলিকুর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
অন্যান্য ফল: বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে। কলা, পেঁপে বাগানে পরিচর্যা বা যত্নের প্রয়োজনীয় কাজগুলো দেরি না করে এখনই সম্পন্ন করতে ফেলতে হবে।
প্রাণিসম্পদ: বিভিন্ন প্রাণীর রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হবে। তাছাড়া ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব ও দেখা দিতে পারে। তাই খাবারের সঙ্গে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে।
গবাদিপশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। গবাদিপশুকে উন্নত খাবার যেমন-সবুজ ঘাস, ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এসব খাওয়াতে হবে। যে কোনো সমস্যা সমাধান করেত উপজেলা পশুসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
মৎস্যসম্পদ: মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে।
এছাড়া শতাংশ প্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে। শীতের পর এ সময় মাছের বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
মাছ যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে প্রতি শতাংশ হিসেবে ১ কেজি করে পাথুরে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপরও যদি না কমে তাহলে ২ সপ্তাহ পর পর আরও ২/১ বার দিতে হবে।
এছাড়া যেকোনো সমস্যায় কৃষি, মৎস্য, ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী কৃষি অফিস থেকে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে ফোন করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
একে/জেডএস