ময়মনসিংহ: ‘আমি চুরি করছি না ভাই। আমি বালুরচর’তে আইছি।
ময়মনসিংহ নগরীর পাটগুদাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক নারীর মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের অভিযোগে স্থানীয়রা তাকে বেদম পেটানোর সময় বার বার এমন আকুতি জানাচ্ছিলো শিশুটি।
বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরের দিকে তাকে বেদম পেটান স্থানীয় ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সফির উদ্দিন সরু।
বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় এ নির্যাতনের ঘটনার ভিডিওচিত্র নগরীতে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তোলপাড়।
গত বছরের ৮ জুলাই চুরির অপবাদ দিয়ে সিলেটের কুমারগাঁওয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয় ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজনকে। সেই নির্যাতনের ২৮ মিনিটের ভিডিওচিত্র খুনিরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে, খুনিদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে জনতা। সেবার অবশ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করে আলোচিত ওই শিশু হত্যা মামলায় ১৩ আসামির মধ্যে ৪ জনকে ফাঁসি, একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তিনজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২ জনকে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত।
রাজনকে নির্যাতনে প্রাণ হারাতে হলেও সাদ্দামকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। আর ৬ মিনিটের ভিডিওচিত্র ধারণকারীরা রাজনের ঘটনার মতো খুনি-নির্যাতনকারীর সহযোগীর ভূমিকা নেননি। বরং নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে শিশুটিকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন।
বাংলানিউজের কাছেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর প্রায় সাড়ে ৬ মিনিটের ভিডিওটি হাতে এসে পৌঁছে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, শিশু সাদ্দাম কাকুতি-মিনতি করে একজনের পা ধরে রেখেছে আর কাঁদছে। তাকে ঘিরে আছেন জনাদশেক মানুষ। তারাও শিশুটির সঙ্গে হাস্য-রসিকতা করছেন।
এরপর নীল চেক শার্ট পরিহিত ওই আওয়ামী লীগ নেতা একটি দোকানঘরে নিয়ে শিশুটির শার্ট চেপে ধরে লাঠি দিয়ে দু’ হাতের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে পেটাতে থাকেন। কিছুক্ষণ এভাবে নির্যাতনের পর শিশুটিকে দোকানঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আবারো তাকে ওই দোকানে আনা হয়।
নির্যাতনের সময় ভিডিও ধারণ করা একজন জিজ্ঞাসা করেন, ‘শিশুটিকে মারছেন কেন?’ তখন একজন বলেন, ‘এক বেডির মোবাইল নিছে’। ওই সময় ভিডিও ধারণকারী বলছেন, ‘কোন বেডি তাকে নিয়া আসেন। এটা শিশু নির্যাতন’।
পাশ থেকেই আরেকজন বলছেন, ‘এইডা চোর, এইলেইগ্যা বিচার করতাছি’।
শিশু সাদ্দামকে পিটিয়ে নির্যাতনের সময়েই সে জানায়, তার বাড়ি বাঘমারা। সে বার বার বলছিল, ‘আমি চুরি করছি না ভাই’।
তবে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের দাবি, আক্রান্ত সাদ্দাম একজন পেশাদার ছিনতাইকারী। এর আগেও দু’বার সে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। তবে ভিডিওটি হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে নির্যাতিত শিশু সাদ্দামের মা পারভীন আক্তার স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, বুধবার দুপুরের দিকে নেত্রকোণায় যাওয়ার পথে সফির উদ্দিনসহ কয়েকজন তার ছেলেকে ধরে নিয়ে লাঠিপেটা করেন। পরে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ তার ছেলেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
ওসি কামরুল ইসলাম দাবি করেন, এ শিশুটি একজন পেশাদার ছিনতাইকারী। ইতোপূর্বেও ছিনতাইয়ের অভিযোগে দু’বার গ্রেফতার হয়েছিল।
তিনি বলেন, পাটগুদাম ব্রিজ মোড় বাসস্ট্যান্ডে এরা ওঁৎ পেতে থাকে। বাস থেকে নামা নারীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। বুধবারও এ অভিযোগে শিশুটি আটক করা হয়। পরে তার মা ও খালার জিম্মায় শিশুটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওসি কামরুল ইসলাম আরো জানান, ভিডিওটি আমি পেলে যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত করণিক হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে শিশুটিকে হাসপাতালের ৮নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
তবে সন্ধ্যার পর হাসপাতালের ৮নং ওয়ার্ডে গিয়ে শিশুটিকে পাওয়া যায়নি। দায়িত্বরত সেবিকা নাসিমা আক্তার বাংলানিউজকে জানান, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিশুটি মারামারির ঘটনায় এখানে ভর্তি হয়েছিল। তখন আরেকজন ডিউটিতে ছিলেন। আমি এসে শিশুটিকে আর পাইনি’।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৬
এএসআর