ঢাকা, সোমবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

কলাগাছে ‘হৃদয়ের মিনার’!

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
কলাগাছে ‘হৃদয়ের মিনার’! ছবি: অনিক খান/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: হাতের কাছে নেই শহীদ মিনার। বাড়ি থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দূরত্বও প্রায় দেড় কিলোমিটার।



তাই বলে কী ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া শহীদদের জন্য ভালবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করা হবে না?

ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাই শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাড়ির আঙিনায় কলাগাছ, বাঁশের কঞ্চি ও কাগজ দিয়ে তৈরি করেছে প্রতীকী এক শহীদ মিনার।

তার নামও দেওয়া হয়েছে ‘হৃদয়ের মিনার’।

বাঙালি জাতির চেতনার লাল মশাল মহান একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে নিজেদের তৈরি মিনারে নগ্ন পায়ে বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে ভাষাশহীদদের।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি আবেগ ও গভীর ভালবাসার এ অনুপম দৃষ্টান্ত দেখা গেলো ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার নিভৃত এক গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে স্থানীয় পূর্ব মধ্যপাড়া নামের এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার।

শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে প্রত্যন্ত ওই গ্রামে গিয়ে একদল শিশুর এমন হৃদয়ের মিনার গড়ার কর্মযজ্ঞ দৃষ্টিতে আসে। এ গ্রামের বসতবাড়ির আঙিনায় স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোয়াইব এ শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোক্তা।

এ গ্রামেরই স্থানীয় আরেকটি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী কবির, ইমন, পারভেজ, আশরাফুল, ফেরদৌস, পাভেল, রিয়া ও রোহান নিবিষ্ট মনে মগ্ন কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরিতে।

ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা জানায়, কলাগাছ কেটে প্রথমে মাটিতে গর্ত করে পোঁতা হয়েছে। নিচের দিকে মাটি ফেলে অনেকটা বেদির মতো বানানো হয়েছে। এসব মিনারের ওপর ছোট কলাগাছ আবার একটু তীর্যকভাবে আটকানো হয়েছে।

এরপর পোস্টারের সাদা কাগজ ডিজাইন করে কাটা হয়েছে। কাগজে বালি (গাম) লাগিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি মিনারে। প্রতিটি মিনারে রাতের বেলায় দেওয়া হবে রঙিন কাগজ আর নানা রঙের ফুল।

কথার বলার সময়েই ছোট্র ইমনের হাঁক, ‘ভাই, আমিও শহীদ মিনার বানানোতে ছিলাম। কাল (রোববার) ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ রাতেই আমরা ফুল দেবো। শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবো’।

এ সময় আপনমনে কোমলমতি শিশুরা গেয়ে ওঠে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি। আমি কী ভুলিতে পারি....’।

ভাষার জন্য অকাতরে জীবন দেওয়া সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরদের ভোলেনি কবির, ইমন ও পারভেজরা। ওদের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ নামক পাঠ্যবইয়ে মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে।

প্রতিদিন এ বিষয়ের ওপর এক ঘণ্টা ক্লাস হয়- জানায় পারভেজ (১০)।

ক্ষুদে শিক্ষার্থী আশরাফুল জানায়, তাদের গ্রামে কোনো শহীদ মিনার নেই। তাই তারা এবার নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় কলাগাছ, বাঁশের কঞ্চি আর কাগজের শহীদ মিনার তৈরি করবে।

সে মোতাবেকই শনিবার সকাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে।

একুশের প্রথম প্রহরে খালি পায়ে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করবে। এরপর কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে ওরা।

দেখা গেলো, কলাগাছের তৈরি শহীদ মিনারের চারপাশে আবার কঞ্চিতে রশি বেঁধে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই রশিতে লাখো শহীদের রক্তে কেনা লাল-সবুজের কাগজের পতাকা ঝোলানো হচ্ছে।

শুধু কী পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ওদের অহঙ্কারের একুশ উদযাপন। জগতখ্যাত সেই ঐতিহাসিক গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’সহ দেশাত্মবোধক নানা গান বাজানো হবে সাউন্ড বক্সে।

পাশের বাড়ি থেকে আনা হয়েছে ছোট আকারের এ সাউন্ড বক্স- জানায় সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া সোয়াইব।

‘দূরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে হয়। এজন্যই এ আয়োজন। আমাদের গ্রামেও একদিন শহীদ মিনার হবে। সেই শহীদ মিনারে আমরা সবাই একসঙ্গে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করবো’- অমিত দৃঢ়তা নিয়ে বলছিলো এ ক্ষুদে শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীদের এমন কর্মযজ্ঞ পাশ থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স তার।

তার ভাষ্যে, ‘শৈশবে আমরাও এভাবেই শহীদ মিনার তৈরি করতাম। সেখানে ফুল দিয়ে শহীদ দিবস পালন করতাম’।

জাতীয় চেতনার মূল্যবোধ নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে মন্তব্য করে প্রেসক্লাব ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক মো: শামসুল আলম খান বলেন, ‘আজ তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমের চেতনায় বেড়ে উঠছে। সেই ধারায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা শহীদ মিনারের অভাব অনুভব করছে। তাদের সামর্থ্য নেই। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে তারা তৈরি করছে কলাগাছের শহীদ মিনার। তাদের এ উদ্যোগ ও কর্মপ্রয়াস নি:সন্দেহে গর্বের’।

বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।