ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলানিউজকে ড. জীনাত ইমতিয়াজ

ভবিষ্যতে ভাষার বাধা বলে কিছু থাকবে না

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
ভবিষ্যতে ভাষার বাধা বলে কিছু থাকবে না অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী/ ছবি: দেলোয়ার হোসেন বাদল

ঢাকা: ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অগণিত প্রাণ বিসর্জন। সেই ত্যাগ থেকে বাংলা ভাষার প্রাপ্তি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলার পরিচিতি।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটেরও প্রতিষ্ঠা।
 
প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসরমান। ভাষার মাসে, একুশে ফেব্রুয়ারির আগে ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম, ভবিষত পরিকল্পনা নিয়ে বাংলানিউজের সাথে একান্তে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী।
 
অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ বলেন, আজকের সেগুনবাগিচার এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন- বিশ্বের বিপন্ন, প্রায় বিপন্ন, অবলুপ্ত ভাষাগুলো ছাড়াও সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণ, প্রমিতায়ন প্রয়োজনে পুনরুজ্জীবনের জন্য ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউ তৈরি করতে হবে।
 
যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইনস্টিটিউট তৈরি করছি, ভৌত সুযোগ-সুবিধা তথা ভবন, জনবল, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধিসহ আনুসঙ্গিক সুযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় এই ইনস্টিটিউট।
 
ইনস্টিটিউট যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পূর্ণ নকশা অনুযায়ী হয়নি, আগের সরকার আচরণ এর জন্য জন্য দায়ী বলে জানান অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
 
বর্তমান সরকার আইন করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রবিধান হওয়ার পর জনবল নির্ধারণ করা হয়েছে, কিছু কিছু নিয়োগও হয়েছে, আগামী ১/২ মাসের মধ্যে বাকী প্রক্রিয়াও শেষ করতে হবে।
 
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে এই ভবনে স্পেস ছিল না, তখন ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হলো, এই অর্থ বছরে কাজ শেষ হবে।
 
বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সম্পন্ন জনবল, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, আইটির সুবিধা- গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এগুলো থাকতে হবে। লোকবল ঠিক হলো, গ্রন্থাগার হচ্ছে, আইটি সুবিধা হতে যাচ্ছে। এখন দেশি-বিদেশি গবেষকরা কাজ করবেন। কম্পিউটার ল্যাব হচ্ছে, ল্যাঙ্গুয়েজ স্টুডিও হচ্ছে।
 
এখানে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র হচ্ছে বলে জানান অধ্যাপক জীনাত। সেখানে আধুনিক ভাষা শেখাবো এবং বিদেশীদের বাংলা ভাষা শেখানো হবে। এই ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র- মার্চে চালু হবে। সেখানে ৪/৫টি ভাষা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যে ৫টি দেশে আমাদের জনবল পাঠানো হয় সে সব দেশের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হবে। সেই সাথে ইংরেজিটাও।
 
গতবছরের শেষ দিকে এই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ইউনেস্কো ক্যাটাগরি-২ এ উন্নীত করা প্রসঙ্গে মহাপরিচালক বলেন, ইউনেস্কোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কার্যক্রম তার সমান্তরালে হবে। আমরা অতিরিক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু ইউনেস্কোর সে কার্যক্রমে অবশ্যই আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।
 
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, বহুমাত্রিক ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা- এটাকে ইউনেস্কো গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বলা দরকার, এই প্রতিষ্ঠান যখন তৈরি হয় তখন ইউনেস্কো এই কর্মসূচি গ্রহণ করেনি, সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা-ভাবনা ইউনেস্কো এবং বহি:বিশ্বের থেকে অনেক বেশি প্রাগ্রসর। তার ঘোষণার মধ্যেই এই উদ্দেশ্য বলা ছিল। সেভাবে আমরা কাজও শুরু করেছি।  
 
ক্যাটাগরি-২ স্বীকৃতির আগেই আমরা নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এটা চলতি অর্থ বছরে শেষ হবে। এখন একটা খণ্ড জমা হয়ে গেছে।
 
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, যে কোনো কাজ শুরু করতে হলে স্বদেশ থেকে শুরু করতে হয়। আমাদের বাংলা ভাষা ছাড়াও আরও অনেক মাতৃভাষা রয়েছে, সেগুলো কী অবস্থায়, কোথায় আছে, তার প্রকৃত অবস্থান- যেটা আমরা বলি ভাষিক পরিস্থিতি, সেগুলোকে চিহ্নিত করছি।
 
ওই মানচিত্র অনুসারে আমাদের এখন ওই ভাষাগুলোকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী করে তোলা এবং ভাষাভাষি শিশুরা যাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেই সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
 
চ্যালেঞ্জিং কাজ, অচিরেই শুরু
প্রত্যেক ভাষা সংরক্ষণ, ওইসব ভাষার (বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা) অভিধান, ব্যাকরণ নির্দেশ, লিখন ব্যবস্থা আছে কি না(অধিকাংশ ভাষার নেই); এই লিখন বিধি প্রবর্তন করতে হবে। এই কাজগুলো করার পর ওইসব ভাষার শিশুদের জন্য বই লিখতে হবে। শুধু বই লিখলেই হবে না, শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এইভাবে কাজ করলে ভাষাগুলো বাংলা ভাষার মতই জ্ঞান বিজ্ঞান-চর্চার উপযোগী হবে। ওই ভাষার সম্পদের সাথে আমরা সবাই পরিচিত হতে পারব।
 
ভাষার বাধা যাবে কেটে
এখন যে ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা আছে তা নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেন মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক।
 
ওই যে সমস্ত ভাষা পাচ্ছি, সেগুলো এবং বাংলা মিলে যদি একটা প্রোগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসি, যেমন- ইউএনএল (ইউনিভার্সেল নেটওয়ার্ক ল্যাঙ্গুয়েজ) প্রোগ্রামে নিয়ে এলে মারমা বা চাকমা ভাষা টেক্সট দিলে বাংলায় অনুবাদ বা বাংলা দিলে সেসব ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাবে। এটাও করা সম্ভব, ভবিষ্যত পরিকল্পনার মধ্যে আছে।
 
এটা অনেকটা মেশিন ট্রানসেলেটের মত। কিন্তু মেশিন ট্রানসেলেশনের সীমাবদ্ধতা আছে, ইউএনএল প্যারাডাইমে করতে পারলে সেটা অনেকাংশে অতিক্রম করা যাবে। আরও বেশি কার্যকর হবে। যেমন- বাংলা কোনো নোটিশ চাকমা ভাষায় ক্লিক করলে সে ভাষায় পড়বে, মারমারা মারমা ভাষায় পড়তে পারবে।
 
ট্রান্সলেশনের জন্য অনেক বিষয় দরকার- উৎস ও টার্গেট। এই দুটোর মধ্যে ইকোভ্যালেন্স থাকতে হবে, অর্থাৎ কী বলছি, তার অর্থের সমতা থাকতে হবে। সিমেনটিক ও কালচারাল ইকোভ্যালেন্স থাকতে হবে। এদুটো মিললে অনুবাদ হবে। অনুবাদের জন্য আলাদা প্রোগ্রাম আছে, হঠাৎ করে দিলে হয় না। প্রোগ্রাম অনুযায়ী সোর্স ও টার্গেটকে মেলাতে হবে। এটা চলমান প্রক্রিয়া, এক দিনে সম্ভব না।
 
এখন আইটি সুযোগ-সুবিধা আছে, কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ আছে, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোসেস (এনএলপি) আছে; সে সব ব্যবহার করে বিজ্ঞানী, ভাষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একসঙ্গে বসে কাজ করলে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ভাষার বাধা বলে থাকবে না।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এমআইএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।