বরিশাল: বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর খবরে সারাদেশের মতো বরিশালও উত্তাল হয়ে উঠে।
এ আন্দোলনে অনেকের মতো তৎকালীন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ইউসুফও (কালু) সংগ্রামী ভূমিকা রাখেন।
৮২ বছর বয়সে আজও ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সেই দিনগুলো তার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।
বাংলানিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ভাষা আন্দোলনের নানান বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
১৯৩৪ সালে বর্তমান ঝালকাঠির রাজাপুরের কান্দেশকাঠি মিয়াবাড়িতে জন্ম নেওয়া এ ভাষাসৈনিক পড়াশুনার কারণে বরিশালে আসেন ১৯৪১ সালে।
তিনি জানান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সাল থেকেই বরিশাল ছিল আন্দোলন মুখর। সভা-সমাবেশ মিছিল মিটিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করার পাশাপাশি শহর-গ্রামে জনমত তৈরি শুরু করে এখানকার ছাত্রসমাজ।
স্মৃতিচারণকালে তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালে যখন আমি বিএম স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ি, ঠিক তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। আমার বেশ কয়েকজন সহপাঠীও এতে জড়িয়ে পড়ে। তখন যদিও বরিশালে বিএম কলেজ কেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। তারপরও তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মিছিল মিটিং এ অংশগ্রহণ করতাম।
এসময় তিনি বলেন, ১৯৫০ সালে বশির আহম্মেদ নামে এক বিহারি এসপি’র কারণে হিন্দুরা এখানকার জায়গা-জমি ফেলে দেশ ত্যাগ করে।
এতে প্রভাব পড়ে বরিশালে সাংস্কৃতিক জগতের ওপরে। প্রভাশালী সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে গান-বাজনা, থিয়েটার-নাটক হতো তার পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে আবার ১৯৫১ সাল থেকে আস্তে আস্তে এগুলো মেকাপ হতে থাকে। এসময়টায় শহীদ আলতাফ মাহমুদ বরিশালে ছিলেন এবং পড়াশুনা করতেন।
১৯৫১ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করে বিএম কলেজে আইএ-তে ভর্তি হন। এরপর থেকে আরো জোরদারভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইউসুফ (কালু)।
তিনি বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটা ছিলো সারা দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের। এটি ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারণ ছিলো। তখন বরিশালেও আমরা এ কর্মসূচি পালন করি। বরিশালের সদর রোড, চক বাজার, বগুড়া রোড, আলেকান্দায় শহরের বিভিন্ন স্থানে মিছিল হয়েছে।
রাতে গুঞ্জন শুনি ঢাকায় গণ্ডগোল হয়েছে। তখন মোবাইলও ছিলো না, টেলিফোনও ছিলোনা। ছিলো শুধু টেলিগ্রাফ। আর তাও কে কাকে করবে। এসব পুলিশের দখলে থাকতো, তারা কি আমাদের এসব তথ্য দেবে। তারপরও এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে শুনে শুনে রাতেই শহরে মিছিল বের হয়।
তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মরহুম আব্দুল মালেক খানের সভাপতিত্বে সার্কিট হাউস সংলগ্ন মুসলিম ইনস্টিটিউট নামে লাইব্রেরিতে মিটিং ডাকা হয়। ওই মিটিং এ ঘোষণা করা হয় ৮১ সদস্য বিশিষ্ট বৃহত্তর বরিশাল জেলা (বর্তমান বরিশাল বিভাগ) রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। যেখানে সভাপতি মরহুম আব্দুল মালেক খান ও যুবলীগের সম্পাদক মরহুম আবুল হাসেম ভাইকে নেতা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এর আগেই আমাদের বিএম কলেজে ২৫ সদস্যের ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ছিলো- যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খানের শশুর সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। সেটিকে বিলুপ্ত করে এই কমিটির সংযুক্ত করে নেওয়া হয়। বিএম কলেজের কমিটির সদস্য থাকায় নতুন কমিটিতেও আমার জায়গা হয়ে যায়।
এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে যে মেইল ছেড়ে আসে তাতে বাউফলের মরহুম সৈয়দ আশরাফ আর ভোলার সামসুল হুদা বরিশালে আসেন। তাদের হাতে একটি ইমারজেন্সি টেলিগ্রাফ পত্রিকা ছিলো। এটিও খুব গোপনে ছাপা হয়। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে তারা বরিশালে নামলে সেটি আমরা দেখে ঢাকার গণ্ডগোলের বিষয়টি নিশ্চিত হই।
ওইসময়ই বরিশালে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। গায়েবানা জানাযা, শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
২৩ তারিখে বরিশালে বিরাট এক মৌন মিছিল বের করা হয়। এটি শহরের সব রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। যে মিছিলে শুধু নারীর সংখ্যাই ছিলো ৪শ’র বেশি। ওই সময় লোকসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে অত বড় মৌন মিছিল চিলো চিন্তার বাইরে।
২২ তারিখ রাত থেকেই টাউন হলের সামনে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। যেটি নির্মাণের কয়েকদিন পরে এক রাতে পুলিশ ভেঙে ফেলে। পর্যায়ক্রমে আন্দোলন চলতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে মিছিল মিটিং হতো। মিছিলে আলতাফ মাহমুদ গান গাইতেন। ভাষা আন্দোলনের ঘটনার পর গফ্ফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি’ গানটি সুর সহকারে আলতাফ মাহমুদ গাইতেন। আমাদের সঙ্গে মিছিলেও বের হতেন।
এরপর ১৯৫৪ তে নির্বাচন দিলো পাকিস্তান সরকার। এ কে ফজলুক হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের পূর্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান আব্দুল কাইয়ুম খান বরিশালে আসেন প্রচারের জন্য, আমরা তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও স্বৈরাচারী সরকার নিপাক যাওয়ার দাবিতে কালো পতাকা ও ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করি, ওই সময় বিক্ষোভে মুসলিম লীগের মালেক নামে একজন মারা যান। যার বাড়ি বরিশালের কাউনিয়ায় ছিলো।
পুলিশের সঙ্গে সে সময় ব্যাপক দাঙা-হাঙামা হয়, ঘটে লাঠিচার্জের ঘটনা। এ ঘটনার জের ধরে মামলায় আমার ৩০-৩৫ জনের মতো গ্রেফতার হই। জেল দিয়ে ২০/২২ দিন পরে জামিনে বের হয়ে আসি এবং নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ শুরু করি। আমি নিজে ঝালকাঠি, রাজাপুর, মঠবাড়িয়া, গলাচিপায় গেছি। গলাচিপায় নির্বাচনের দিন নুরুল ইসলাম মঞ্জুর সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাত হয়। ৯ সিট বাদে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে যুক্তফ্রন্ট হয়।
এরপর প্রাদেশিক আইন পরিষদে ৫৪ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা পাস হয়। কিন্তু এর তেমন কোনো কার্যকরিতা ছিলোনা। পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়। তাই এককথায় ভাষা আন্দোলন ’৫৬ সাল পর্যন্ত চলেছে।
তিনি বলেন, এখন তো তোমরা অনেক কিছু দেখো। কিন্তু সে সময় এ দেশে মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলো না। চাকরি-বাকরিতে সমস্যা ছিলো। লিমিটেড চাকরি ছিলো। এসব জায়গায় বিহারি-পাঞ্জাবিরা এসে চাকরি করতো। পুলিশে-আরমিতে সবই তারা ছিলো।
এখন কতো কাগজ, পত্র-পত্রিকা। তখন এতো ছিলোনা। তারপরও পুরোনো খবরের কাগজ সংগ্রহ করতাম এবং লাল কালি বড় করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই লিখে পোস্টার তৈরি করতাম। এখন তো প্রেসে সব হয়ে যায়। তখন পেপারের দামও ছিলো বেশি। আর সবকিছুই ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিলো। যারা আন্দোলন করতো তাদের পয়সা কোথায়। কোনো শিল্পপতি ব্যবসায়ী ছিলোনা। এখন তো চাইলেই পায়।
উদাহরণ হিসেবে বলি, তখন বরিশাল থেকে মেইল (স্টিমার) যাইতো, যার টিকিট ছিলো ইন্টারক্লাস ৬ টাকা, ৪ টাকা ১২ আনা থার্ড ক্লাস। তাহলে, এখন যে আয়- আর যে ভাড়া, তার সঙ্গে তুলনা করো দেখবে, তখন কতো বেশি ছিলো এর ভাড়া।
ইউসুফ কালু বলেন, শুরু থেকেই পাকিস্তানিরা বাঙালি বিদ্বেষি ছিলো। একসময় বাঙালিরাও পশ্চিমাদের খারাপ চোখে দেখতে শুরু করে, কারণ ওরা নিজেদের ছাড়া কিছু বুঝতো না, বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতো।
ইউসুফ ১৯৬২ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে আজাদ ও পরে দৈনিক পয়গামের বরিশাল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনের মুখপত্র বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকার পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বরিশাল প্রেসক্লাবের সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিভল খেলায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। ১৯৬২-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বরিশাল ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ছিলেন।
জীবনের প্রথমে শিশু কিশোর সংগঠন মুকুলফৌজ করতেন। এরপর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে তার অসামান্য অবদান। কিছুদিন ছাত্র ইউনিয়ন করে ৫২’তে ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলন, ১৯৭৫ সালের পরে স্বৈরাচার বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
দেখানোর মতো কিছু নেই বলে আফসোস করেন ইউসুফ কালু বলেন, রাজা ভিলায় থাকতে ৭১ সালে আমার বাড়ি লুট হয়। তখন দলিলপত্র, ব্যক্তিগত কাগজপত্র সবকিচুই খোয়া যায়। বহু স্মৃতিও নষ্ট হয়ে যায়।
বর্তমানে পেপার-পত্রিকা পড়ে, টেলিভিশন দেখে, আর বাড়ির সামনে সড়কে হাঁটাচলা, কখনো নাতির সঙ্গে, কখনো চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে তার সময় পার হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এসএইচ/জেডএম