ঢাকা: হিরুকির মুখাবয়ব বলবে তিনি জাপানি। আবার কথা শুনে মনে হবে তিনি বাংলাদেশি।
হিরুকি এতোই বাংলাপ্রেমী যে, নিজেকে যতোটা না জাপানি পরিচয় দেন, তারচেয়ে বেশি পরিচয় দেন বাংলাদেশি হিসেবে। বাংলা এতো বেশি তার পছন্দ যে, আনমনে বাংলা বলে চলেন, ইচ্ছেমত প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে লিখে চলেন বাংলা।
পুরো নাম হিরুকি ওয়াতানাবে। হিরুকির বাংলা প্রেম জানতে তার সঙ্গে কথা শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘২০০২ সালে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে তার বাংলাদেশে আসা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন। মাত্র তিন মাসে বাংলা অনেকটা রপ্ত করে ফেলেন। ৬ মাসের মাথায় শুদ্ধভাবে বাংলায় কথা বলা ও সবার সঙ্গে বাংলায় যোগাযোগ করতে সক্ষম হন।
এখন তিনি একটি বেসরকারি সংগঠনের হয়ে সবার সঙ্গে শুধু বাংলায় কথা বলছেন তা-ই নয়, বাংলায় একটি চলচ্চিত্র তৈরির সঙ্গেও যুক্ত তিনি। শহুরে প্রেম নিয়ে গত পহেলা বৈশাখেই মুক্তি পায় তার ‘কাটুস কুটুস প্রেম’ চলচ্চিত্র।
হিরুকি প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনে যান শহীদ মিনারে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ গানটির চারলাইন গাইতে গাইতে ফুল দেন বেদি স্পর্শ করে। এসময় তার চোখে অশ্রু ঝরে।
হিরুকি বলেন, আমি একুশের ভোরে, সকালে এবং দুপুরে তিনবার শহীদ মিনারে যাই। যখন লাইনে দাঁড়িয়ে ফুল দিই, আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি শুনি, তখন অঝোরে চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি একটি স্কুলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে কাটাচ্ছেন তিনি।
বাংলা ভাষার এই বিদেশি বন্ধু বলেন, আমাকে বাংলা শিখতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটের বন্ধুরা। শিখতে গিয়ে বাংলা ভাষা একটু কঠিন মনে হলেও জাপানের সঙ্গে এ ভাষার ব্যাকরণগত অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি। আমি এখন বাংলায় বলা, লেখা ও পড়ার কাজ করতে পারি খুব সহজেই।
হিরুকি মনে করেন, বিদেশি কেউ বাংলা তিন মাসেই শিখতে পারবে। তবে ভালো বাংলা ছয় মাসে সবাই শিখতে পারবে।
বাংলা ভাষা শিখতে পেরে অনেক আনন্দিত জাপানি নাগরিক হিরুকি। তিনি বলেন, মানুষ নিজের প্রাণ আর রক্ত দিয়েছে যে ভাষার জন্য, সেই ভাষা শিখে অনেক ভালো লাগছে। এর মাধ্যমে প্রতিটি জাতি তার ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শিখেছে।
বাংলাদেশে ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে থেকে হিরুকির উপলব্ধি, এ দেশের মানুষের মধ্যে অনেক আন্তরিকতা। এখানে সংস্কৃতির জায়গাটা খুব বিশাল,-যা তাকে মুগ্ধ করেছে।
হিরুকি জানান, জাপানে থাকা তারা মা-বাবাও কিছু কিছু বাংলা বলতে পারেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং তার মতোই একজন জাপানি নাগরিককে বিয়ে করেছেন।
বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদের প্রতি হিরুকির পরামর্শ দেন, বাংলা ভাষা চমৎকার । তাই এ ভাষায় কথা বলতে গিয়ে ইংরেজি যোগ করলে খারাপ দেখায়, যেমন খারাপ দেখায় ইংরেজি বলতে গিয়ে কেউ বাংলা শব্দ যোগ করলে।
তিনি বলেন, যখন বাংলায় কথা বলি তখন বাংলার মধ্যেই কথা বলা উচিত। বাংলা কথা বলতে গিয়ে আমরা যেসব ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করি, তার চমৎকার বাংলা শব্দ রয়েছে।
হিরুকি জানান, ২০০২ সালে এসে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। কাজ করছেন ‘একমাত্রা সোসাইটি’র সঙ্গে। এ সংগঠনের হয়ে পথশিশুদের উন্নয়নে তিনি শিশুদের সঙ্গে কথা বলা পড়ালেখা শেখানো সব কাজ করে থাকেন।
একমাত্রা সোসাইটি একটি অলাভজনক প্লাটফর্ম, যা মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। পিছিয়ে পড়া শিশুদের অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে একমাত্র সোসাইটি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও আবাসন সুবিধাসহ নানামুখী সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এসএ/এইচএ