ঢাকা: বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালিরাই এই ভূ-খণ্ডের আদিবাসী বলে বিদেশি কূটনীতিকদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
এছাড়া জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ফোরামের ২০১১ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারীদের ‘ভুলভাবে’ উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দারা ‘উপজাতি’, তারা আদিবাসী নয়।
‘আদিবাসী’ ইস্যুতে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতে ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্প্রচার অণুবিভাগের মহাপরিচালক শামীম আহসান কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেন।
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনক্লস ভবনের সভাকক্ষে এ অবহিতকরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত পুরনো বাসিন্দাদের নিয়ে চলমান বিতর্কে সরকারের অবস্থান জানাতে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমন্ত্রণ জানায় সরকার।
জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ফোরামের সর্বশেষ সংখ্যার ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ‘উপজাতি’ (ট্রাইবাল) ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র (এথনিক মাইনরিটি) মানুষকে ‘আদিবাসী’ (ইনডেজেনাস পিপল) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
শামীম আহসান জানান, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থাপন করে বিদেশি কূটনীতিকদের বলেন, ‘ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মুঘল ও ব্রিটিশ রাজত্বকালে মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর এসব মানুষ অর্থনৈতিক কারণে আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বসতি স্থাপন করে। এরা উপজাতি; কোনওভাবেই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়। ’
‘১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তিতেও তাদের উপজাতি হিসেবেই অভিহিত করে চুক্তি হয়’, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৬ সালে হান্টারের করা ভারত জরিপ, ১৯০০ সালের পার্বত্য অঞ্চল চুক্তি, ১৯৮৯ সালের পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন-সবকিছুতেই এই বাসিন্দাদের উপজাতি বলা হয়। ’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিকাশ, আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনামল ও জাতি হিসাবে আমাদের জন্ম নেওয়া সম্পর্কে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা বৈশ্বিক অপপ্রচার ও ভুল-উপস্থাপনের শিকার হচ্ছি। ’
সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে পার্বত্য অঞ্চলের ওই বাসিন্দাদের শুধু ‘উপজাতি’ হিসেবে নয়, বরং তাদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র মর্যাদা দিয়ে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বলে কূটনীতিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের আরও জানান, আদিবাসী বিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করেনি বাংলাদেশ।
তিনি কূটনীতিকদের আরও বলেন, ‘আদিবাসী সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনও সংজ্ঞা নেই। এমনকী ২০০৬ সালে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক অধিকারবিষয়ক ঘোষণাতেও এমন কোনও সংজ্ঞা দেওয়া হয় নি। ’
তিনি বলেন, ‘অক্সফোর্ড অভিধানেও আদিবাসী শব্দটি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, অন্যকোনও স্থান থেকে না এসে কোনও স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা। ’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, ‘আদিবাসী হিসেবে সেটিই বলা হয়, যদি কোনো উপনিবেশ (কলোনি) প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং কলোনি করতে গিয়ে ওখানকার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা সেই জায়গা দখল করে নেয়। এমন ঘটনা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি তো সেরকম নয়। ’
‘পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয়দের দ্বারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ‘নতুন বিশ্ব’ খোঁজার অভিযানে প্রথম অধিবাসীদের সরিয়ে দেওয়া হয়’ বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ভিন্ন।
বিশেষত, বাংলা অববাহিকার ৪ হাজার বছর ধরে বসবাসকারীরা এখানকারই মানুষ। এই বাঙালিদের তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি, বা অন্য কোনও জাতি এসে বসবাসও শুরু করেনি। ’
‘এই অঞ্চলসহ ভারতবর্ষ শুধু প্রশাসনিকভাবে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিদেশি কূটনীতিকদের তিনি বলেন, ‘প্রাচীন বঙ্গ ভূখণ্ডই আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানকার ৯৯ শতাংশ মানুষই এই অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দা। যাদে ইতিহাস ৪ হাজার বছরের। ’
তিনি বলেন, ‘ঊয়ারী বটেশ্বরে পাওয়া প্রত্ন সম্পদ থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাঙালিরাই এই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা। ’
মঙ্গলবার দুপুরে দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১১