গত ক’দিনে রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর এবং গাবতলী রুটে সরেজমিনে এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস, এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িতেও একই অবস্থা।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখ ৫০ হাজার ১২৪টি। এসবের মধ্যে শুধু বাসের সংখ্যা ২৭ হাজার ৩০২টি। মিনিবাস ১০ হাজার ১৯৪টি। মাইক্রোবাস ৬৭ হাজার ৯১১টি। এসব গাড়িকে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার পর রাস্তায় চলাচলের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তবে বিআরটিএর হিসাবে যা-ই থাক, বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন।
গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী ‘৮ ও ৭ নম্বর’—এর অধিকাংশ বাসেই দেখা যায়, কোনোটির গ্লাস ভাঙা, কোনোটির লুকিং গ্লাসই নেই, কোনোটির সামনে ও পেছনের বাম্পার খোলা, কোনোটির জানালার কাচ অর্ধভাঙ্গা হয়ে ঝুলছে, কোনো কোনোটির আবার বডি দুমড়ানো-মোচড়ানো। আবার কোনো কোনো গাড়ি ভাঙ্গাচোরা না হলেও রাস্তায় চলাচলের সময় ঘষাঘষির কারণে দু’তিন মাসের মধ্যেই রঙ উঠে কদাকার। রাজধানীর মৌচাক মোড়ে যানজটে আটকে থাকা এরকম একাধিক বাস চোখে পড়েছে।
সদরঘাট টু গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ‘সুপ্রভাত পরিবহন’র একাধিক বাসের একই রকম দুরবস্থা দেখা গেছে। একই কথা খাটে যাত্রাবাড়ী থেকে গাজীপুর রুটে চলাচলকারী অনেক বাসের বেলায়। এমনকি ডাইরেক্ট বা বিরতিহীন লেখা অনেক বাসের ভিতরেও আসন আলগা হয়ে আছে। এছাড়া বডি ভেঙে বাঁকা হয়ে থাকা, সামনে পেছনে বাম্পার নেই এমন বাসও ভুরিভুরি। শুধু যাত্রাবাড়ী-গাজীপুর রুটেই নয়, রাজধানীর প্রায় সব রুটের বেশিরভাগ কোম্পানির বাসের অবস্থা একই রকম।
উত্তরা টু আজিমপুর রুটের ফাল্গুন পরিবহন, আব্দুল্লাপুর টু যাত্রাবাড়ী রুটের সালছাবিল, অনাবিল, তুরাগ পরিবহন, গাবতলী টু যাত্রাবাড়ী এবং গাবতলী টু সদরঘাট রুটের অধিকাংশ কোম্পানির বেশিরভাগ গাড়িই লক্কর-ঝক্কর। এসব গণপরিবহনেই ভোগান্তি, শঙ্কা আর বিড়ম্বনা নিয়েই নিয়মিত পথ চলতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে।
ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইনশৃংখলাবাহিনীকে নিয়মিত টাকা দিয়ে তবেই তারা এসব গাড়ি চালাচ্ছে। প্রতিবছর যখন বিআরটিএ’র অভিযান জোরদার থাকে তখন এসব গাড়ি ঢাকার আশপাশে পাঠানো হয়। অভিযান গতি হারানোর পর এগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে প্রবেশ করে।
জহির নামের ‘৮ নম্বর’ বাসের এক চালক বলেন, ট্রাফিক পুলিশের সাথে মালিকপক্ষের ‘চুক্তি’ (বোঝাপড়া) আছে। অভিযানের সময় ছাড়া গাড়ি ধরলে ছেড়ে দেয়। কারণ ট্রাফিক পুলিশকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয় মালিক।
শাহেদ নামের সুপ্রভাত পরিবহনের এক চালক বলেন, গাড়ির ফিটনেসের জন্য মাঝেমাঝে ধরলে কিছু টাকা দিলে ছেড়ে দেয়। টাকা না দিলে অবশ্য বিভিন্ন ধারায় মামলা দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ব্যবহারের অনুপযোগী যানবাহনের মালিকদের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের মধ্যেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুর্নীতি। কোনো জনপরিবহনকে রাস্তায় চলাচলের জন্য বিবেচিত হতে হলে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সামান্য সংখ্যক যানই এসব পরীক্ষায় উৎরে যেতে পারে। তারপরও মালিকদের হস্তক্ষেপে গাড়িগুলোকে যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই শুধু বাইরের রঙ দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তারা।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার জনপরিবহন খাতে ব্যাপক অসঙ্গতি ও অনিয়ম দূর করা এবং ব্যবহারঅযোগ্য বাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহলের বাধায় সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত বেশিরভাগ বাসই ২০ বছরের পুরোনো। এসব বাসের একটা বড় অংশ কালো ধোঁয়া নির্গমন করে। এসবের ব্রেকও থাকে ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া অবৈধ হাইড্রলিক হর্নের কারণে এবং যথাযথ রিয়ার ভিউ মিরর ও সিগন্যাল বাতির অভাবে এগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তারওপর বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বেশিরভাগ যানবাহনেরই নেই বৈধ লাইসেন্স।
বিআরটিএর সচিব মো. শওকত আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত ১০ বছরেও আমাদের কাছে ফিটনেসের জন্য আসেনি যেসব গাড়ি তাদের লাইসেন্স এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে। এমন গাড়ির সংখ্যা ৬ লাখের উপরে। আমরা পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি তারা যেন বিআরটিএতে এসে লাইসেন্স নবায়ন করিয়ে নেয়। তাতেও কাজ হয়নি। তারপরও আমরা সুযোগ রেখেছি, যে কেউ এলেই গাড়ির অবস্থা দেখে ফিটনেস দেয়া হবে। ’
তিনি বলেন ইতিমধ্যে লাইসেন্সই বাতিল হওয়া এসব ফিটনেসবীহিন গাড়ি ধরতে রাজধানীর সড়কগুলোতে প্রতিদিন বিআরটিএর ভ্রাম্যান আদালত কাজ করছে। আদালত ফিটনেসহীন গাড়ি জব্দ করাসহ বিভিন্ন ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশেরও একাধিক টিম ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে কাজ করে। এছাড়া প্রতিটি থানার পুলিশকেও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া রয়েছে। এছাড়া মাঝে মাঝে বড় আকারে অভিযানও চালানো হয় ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে ২০ বছরের পুরোনো যানবাহন সরিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে সরকার। তবে এ ব্যাপারে এখনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চলতি বছর ঘোষণা দিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। অভিযান পরিচালনা করে যৌথভাবে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। অভিযান পরিচালনায় সহায়তা করেন পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তবে শেষ পর্যন্ত আবার আগের অবস্থায় চলে যায়। পরে যাত্রী চাহিদা ও গাড়ি সংকটের বিষয় মাথায় রেখে ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেন, রিপ্লেসমেন্টের আগে সব ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তা থেকে উঠিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। রাজধানীতে চলাচলের জন্য নতুন বাস আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব বাস আসার আগে ফিটনেসবিহীনগুলো রাস্তা থেকে উঠিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘আর কিছুদিন পর ঢাকা উত্তর সিটিতে পুরাতন গাড়ি থাকবে না। নতুন করে অনেকগ গাড়ি কেনাসহ আমরা ফ্রাঞ্চাইজিং পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঢাকা সিটির মধ্যে চলাচলকারী গাড়িগুলোর এখন প্রায় ২ হাজার মালিক রয়েছে। এদের মধ্যে কারো ২ টা গাড়ি, কারো ৫ টা গাড়ি কেউবা আরো বেশি গাড়ির মালিক। তাঁরা এক হতে চায় না (ফ্রাঞ্চাইজিংয়ের আওতায় আসতে চায় না)। তারপরও এখন সবক’টি কোম্পানিকে এক করতে সক্ষম হয়েছি। সাবাইকে মাত্র ৫ টি কোম্পানির আওতায় এনে ফ্রাঞ্চাইজিং পদ্ধতির মাধ্যমে বাস চলবে। এই পদ্ধতি চালু হলে একটি গাড়ি আরেকটির আগে উঠবে না। সবাই সবার পিছে পিছে চলবে। একই রুটে আলাদা কোম্পানির কোন গাড়ি থাকবে না। এর জন্য এখন পলিসি নির্ধারণ চলছে। আসলে গাড়ি নামানো তেমন কোন বিষয় না। কিন্তু সেটা ব্যবস্থাপনা করাটা কঠিন। নতুন এই পদ্ধতির জন্য টার্মিনাল ও ওয়ার্কশপ তৈরি করতে হবে। নতুন করে রুট নির্ধারণ ও স্টপেজ নির্মাণ করতে হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে দেয়া বা রাস্তায় নামানোর ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। আমরা সিটিকে সুন্দর ও যানজটমুক্ত করতে নতুন গাড়ি নামানোসহ ফ্রাঞ্চাইজিং পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেটা গ্রহণ করায় এখন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। যেহেতু একটা নতুন পদ্ধতির চিন্তা করছি, তাই এই মুহুর্তে পুরাতনগুলো উঠানোর চিন্তা নেই। নতুনগুলো নামিয়ে পুরাতনগুলো রাস্তা থেকে তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৭ ঘণ্টা, ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭
এএম/জেএম