ভয়াল সেই রাতের সাক্ষী হয়ে কাতর কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন আগুনে সর্বশান্ত শাহেদা বিবি।
স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি রোডের চাঁনমিয়া হাউজিং বস্তিতে দীর্ঘদীন ধরে বসবাস করছিলেন শাহেদা বিবি।
ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া রত্না আর কেজি ওয়ানে পড়ুয়া সুমাইয়ার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত শাহেদা। তার ভাষায়, মেয়েগোর বই খাতা পুইরা গেছে। এখন কি হইবো। তাদের ভবিষ্যৎ কি হইবো।
বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমগোর টাকা-পয়সা নাই, বই কিইনা দেবার মতো। কাপড় দেবার মতো। আগুন নিইভা গেলে গিয়া দেহি সব পুড়ে ছাই হইয়া গেছে। আমার একি সর্বনাশ হলো।
শাহেদা বিবির মতো আগুনের প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইউনুস। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায়। নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে ৫ বছর বয়সে এসেছিলেন ঢাকায়। সেই থেকে দীর্ঘ ৩০ বছর ঘরে বসবাস করছেন বাঁশবাড়ি বস্তিতে। রিকশা চালিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার। কিন্তু হঠাৎ অজানা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এনে দেয় সেদিনের সেই জলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা। এখন তিনি পাথর হয়ে গেছেন। ঘর পোড়ার সঙ্গে থেমে গেছে জীবনের সব অনন্দ, আয়োজন।
ধ্বংসস্তূপের দিকে চেয়ে রাত কাটাচ্ছেন ৬৫ বছর বয়সী মো. তোফাজ্জল হোসেন। বর্ণনা দিলেন আগুনের সেই ভয়াবহতার। আগুন দেখে খাটের উপর থেকে লাফিয়ে পড়েন। তারপর দেন দৌড়। সঙ্গে আনতে পেরেছেন টিভি। সম্বল হারিয়ে এখন ফুটপাতে রাতযাপন করছেন। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে থাকার ব্যবস্থা হবে এ নিয়ে শঙ্কিত তোফাজ্জল হোসেন।
গত বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরে আগুন লেগে পুড়ে যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি বস্তির দেড় শতাধিক ঘর। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে বস্তি এলাকা পরিণত হয় বিশাল এক ধ্বংসস্তুপে। শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে সেই ধ্বংসস্তূপের উপর মশারি টানিয়ে ঘুমাতে দেখা যায় কয়েকজনকে।
এছাড়া ঘর পুড়ে সর্বশান্ত হয়ে কিছু লোক আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের বাঁশবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ক্লাসরুম ও বারান্দায় গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন অনেকে।
ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প করেছে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড। অস্থায়ী ক্যাম্প করে সহায়তার দিলেও সেই সহায়তার অল্পই পাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বেশি অংশ বেড়িবাঁধ এলাকার বস্তিবাসীরা নিয়ে যাচ্ছেন বলে বাংলানিউজকে অভিযোগ করেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মো. আব্দুস সালাম।
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে কয়েকটি টিম কাজ করেছিল। যেসব টিম নাম, বাবার নাম ইত্যাদি লিখেছিল তারা কার্ড পেয়েছে। আর যে টিম শুধুমাত্র নাম লিখেছিল তারা কোনো কার্ড বা সহায়তা পাচ্ছে না। তাই কর্তৃপক্ষ যেন যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করে এ দাবি তার।
শাহেদা বিবি, ইউনুস ও তোফাজ্জল নয় এমন অনেক পরিবার আগুনে সব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হকের দেওয়া বক্তব্যে আস্থা রেখে এসব বস্তির বাসিন্দারা অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। কখন তাদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে। গড়ে দেওয়া হবে বাসস্থান। অন্তত মাথাগোঁজার ঠাঁই।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
এএম/জেডএস