ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

একুশের শোকটাই আজ শক্তি

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
একুশের শোকটাই আজ শক্তি একুশের শোকটাই আজ শক্তি/ ছবি: রানা-বাংলানিউজ

ঢাকা: একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দিনটি আজ আর শোকের নয়। কালের পরিক্রমায় এটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি।

১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা, মুখের ভাষার মর্যাদার দাবিতে, রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তাদের শোকে বরং তেজদীপ্ত হয়েছিলো পুরো জাতি। সে শোককে শক্তিতে পরিণত করে বিশ্বের বুকে বাংলাকে আজ প্রতিষ্ঠিত করেছে বাঙালি।

শোকের আবহ হলেও বরং একুশ আজ উৎসবের, অধিকার সমুন্নত রাখবার, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে। তাইতো কবি বলেছেন-প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি/আমায় নেবে সঙ্গে/বাংলা আমার বচন/ আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।

৫২ সালের ২১ একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকেই বুকের রক্ত দিয়েই বাঙ‍ালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত রূপ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের রক্তদানের কারণেই ক্ষোভের যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে মাথা ন্যুয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য হয়েছিলো তারা।
 
পাকিস্তানের যে জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন-উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, আজ তার কবরেও রচিত আছে বাংলা বর্ণমালা। বাংলা আজ বিশ্বময়। অনেক দেশের রাষ্ট্রভাষা। একুশ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই আনন্দও কম নয়। একুশের শোকটাই আজ শক্তি/ ছবি: রানা-বাংলানিউজ
 
ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে একুশ ফেব্রুয়ারি জাকজমকভাবে পালন করে বিশ্বের কোটিকোটি বাঙালি। আর বাংলাদেশের আপামর মানুষ শোকের ভাবগাম্ভীর্য দিয়ে একুশের প্রথম প্রহর থেকেই দিনটিকে নিয়ে যায় গৌরবের অনন্য চূড়ায়।
 
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা পর্যায়ের শহীদ মিনারগুলোতে সরকারের উদ্যোগে নেওয়া হয়, নানা আয়োজন। থাকে বেসরকারি উদ্যোগও। ২০ ফেব্রুয়ারির আগে থেকেই আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। তাদের সে আয়োজনে দেশের জনতা যোগ দিতে থাকেন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শহীদ মিনারগুলোতে প্রহর থেকে দিনভর চলতে থাকে পুষ্পস্তবক অর্পন। কোথাও কোথাও শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আয়োজন করা হয় দোয়া মাহফিলের।
 
রাজধানীতে জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনটা আরো বিশাল। পুষ্পস্তবক অর্পনের পরপরই শোকের আবহটাই ভিন্ন রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারও এর আশেপাশের এলাকা পরিণত হয় উৎসবের পীঠস্থান হিসেবে। একুশের শোকটাই আজ শক্তি/ ছবি: রানা-বাংলানিউজ
 
সরেজমিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বই মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, কোলের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহীদ মিনারে এসেছেন শ্রদ্ধা নিবেদনে। এরপর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার আনন্দ উদযাপন করছেন। কেউবা এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ বা ব্যস্ত গল্প করতে।
 
শহীদ মিনারের চারপাশের এলাকায় মূলত মানুষের ঢল নেমেছে। তাদের আনন্দের অনুষঙ্গ দিতে তাই উপস্থিত হয়েছেন হকাররাও। বেলপুরি, ডাব, খেলনা, ফুলের তোরা, পেয়ারা, আইসক্রিম, সাজসহ নানা ধরণের দ্রব্যের পসরা নিয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছেন ফেরিওয়ালারা। বাচ্চারা খেলনাটাই নিচ্ছে, বড়রা খাচ্ছেন পছন্দের খাবার। কেউবা বেলপুরি, কেউবা সাজ, কেউ আবার ডাব। তরুণীরা আবার আইসক্রিমটাই নিচ্ছেন বেশি।
 
প্রেমিক যুগলও মেতেছেন একুশের দিনে। কালো পাঞ্জাবি পড়ে এসেছেন ছেলেরা আর সাদা-কালো রঙ মেশানো শাড়িতে সেজেছেন মেয়েরা। মাথায় ফুলের ঢালা। কি অদ্ভূত সুন্দরে সেজেজে পুরো এলাকা।
 
চারুকলার কিছু ছেলে-মেয়ে আবার রং তুলি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে  অনেকের পথ আটকাচ্ছেন। আবদারের সুরেই বলছেন তাদের কাছ থেকে ‘একুশ’ লেখা আপল্পনা গায়ে-গালে এঁকে নিতে। এই নিয়ে অবশ্য শিশুদের উৎসাহই বেশি।
 
সামগতদের অনেকেই ঢাকার বাইরে, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও এসেছেন। ভারতের নাগরিক বিকাশ কুমার সেন বাংলানিউজকে বলেন, অনেক দিন ধরেই একুশের ফেব্রুয়ারি ঢাকার উদযাপনের চিন্তা ছিল। এবারই চলেই আসলাম। বাঙালিরা দেখি শোককে ঠিক মতই শক্তিতেই পরিণত করেছে। এটা তো সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
 
কোলে করে তিন মাসের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে তুহিন-রোদেলা দম্পতি। তাদের মতে, ‘ভাষা আন্দোলন আমরা দেখিনি। কিন্তু ছোট থেকেই শহীদ মিনারে ফুল দেই। নামাজও পড়ি। সন্তানও যেন প্রথম থেকেই এ শ্রদ্ধাবোধটা রাখতে পারে, তাই নিয়ে এসেছি। ’
 
অমর একুশে বই মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, অন্য দিনের তুলনায় সেখানে ভিড় বেশি। আজকের দিনটি যেন বই উপহার দেবারও উপলক্ষ্য হিসেবেই ধরা দিয়েছে। আবিদা সুলতানা নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে বলেন, বন্ধুকে বই উপহার দেবেন। তাই স্টলে স্টলে ঘুরছেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
ইইউডি/বিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।