বন বিভাগের হিসেবে, সুন্দরবনে বেশি পর্যটকদের আগমন ‘করমজল’ ও ‘হাড়বাড়িয়া’ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে। বাগেরহাটের মংলা হয়ে এই দুই ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে যাওয়া সবচেয়ে সহজ।
তবে মংলা থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার সহজ ও জনপ্রিয় এই রুটে পর্যটকদের জন্য নেই তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা। ফলে প্রতিদিনই দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের।
গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিব সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হলেও এখানে কোনো কিছুরই সু-ব্যবস্থা নেই। খাবারের দাম বেশি। নেই ভালো মানের কোনো হোটেল রেস্টুরেন্ট, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসার স্থান বা যাত্রী ছাউনি। এমনকি টয়লেট সুবিধাও নেই এখানে।
দীর্ঘ যাত্রা শেষে সুন্দরবনে ঢোকার আগে কেউ যদি হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেস হতে চায় তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। গাড়ি পার্কিং থেকে নৌযানে ওঠা সবখানেই টাকা দিতে হয়। কিন্তু সেবা নেই, উল্টো ভোগান্তিতে পড়তে হয় পর্যটকদের।
সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে সুন্দরবনে শিক্ষা সফরে আসা বাগেরহাটের উদ্দীপন বদর-সামছু বিদ্যানিকেতনে সহকারী শিক্ষক ইকবার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনে যাওয়ার আগে মংলা পৌঁছে সামান্য বিশ্রাম বা হাত-মুখ ধোয়ার কোনো সু-ব্যবস্থা নেই। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ইজারা দেওয়া পিকনিক স্পট বা বন বিভাগের রেস্ট হাউজের কাছে কোনো যাত্রী ছাউনিও নেই। তাই বাস থেকে নেমে সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিক্ষা সফর বা সুন্দরবনে ঘুরতে এসে এখানে গাড়ি পার্কিং ও রান্নার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। ইজারার নামে টাকা নেওয়া হলেও পিকনিক স্পট হিসেবে পর্যটকদের আনুষঙ্গিক কোনো সুযোগ-সুবিধেই নেই এখানে।
পরিবার নিয়ে সুন্দরবনে ঘুরতে আসা ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সিদ্দিক আলম শাওন বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য মংলা ফেরিঘাট এবং বনবিভাগের রেস্ট হাউজ সংলগ্ন নদীর তীরে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের নৌযান রয়েছে। তবে এগুলোর কোনো নির্ধারিত ভাড়া নেই। যে যার মতো ভাড়া নেয়।
ট্রলার-জালিবোটের স্টাফরা টানা হেঁচড়া করে পর্যটকদের সঙ্গে। তাদের চাপিয়ে দেওয়া ইচ্ছে মতো ভাড়া আর দরকষাকষিতে হয়রান হতে হয়। এছাড়া ঘাট না থাকায় ওঠা-নামার সমস্যা তো আছেই।
তিনি বলেন, মানুষ ঘুরতে আসে কিন্তু টাকা খরচ করতে। কিন্তু সেজন্য তারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও ভালো পরিবেশ চায়। এগুলো না থাকলে কেবল বিদেশি পর্যটকই নয়, দেশি পর্যটকরাও আগ্রহ হারাবে।
মংলার 'দি সাউদার্ন ট্যুরস'-এর মালিক মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, মংলা দিয়ে যারা সুন্দরবনে যান, ঘাট না থাকায় সবারই অসুবিধায় পড়তে হয়। বিশেষ করে নদীতে ভাটার সময়। পানি কমে যাওয়ায় এসময় নৌযান তীরে ভিড়তে পারে না। এতে পর্যটকদের ঝুঁকি নিয়ে কাদার ভেতর দিয়ে নৌযানে ওঠা-নামা করতে হয়।
কাঠের চিকন তক্তা বেয়ে নৌযানে উঠতে গিয়ে হরহামেশাই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পর্যটক ও সাধারণ যাত্রীরা।
দ্রুত এখানে পন্টুনসহ ঘাট নির্মাণ এবং পর্যটকদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
বনবিভাগের তথ্য অনুয়ায়ী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের অন্তর্গত চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট পর্যটক এসেছেন ৮১ হাজার ২১৪ জন, যার মধ্যে তিন হাজার ৭৪১ জন বিদেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পর্যটক এসেছে ৯৪ হাজার ৩৫৮ জন, যার মধ্যে বিদেশি দুই হাজার ৫৩৭ জন।
ওই দুই অর্থবছরে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ পর্যটকদের কাছ থেকে রাজস্ব উপার্জন করেছে যথাক্রমে ৮৫ লাখ ৩১ হাজার ২৭০ টাকা এবং ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮০ টাকা।
নিরাপত্তা, অবকাঠামো, দক্ষ ট্যুরিস্ট গাইডসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়লে এ খাতের রাজস্ব কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মংলা থেকে সুন্দরবন যেতে পর্যটকরা যেখান থেকে লঞ্চ, ট্রলার বা জালিবোটে ওঠেন, ওই জায়গা মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে। তাই চাইলেও ওই স্থানে আমাদের ঘাট নির্মাণ করার সুযোগ নেই। তাছাড়া পিকনিক স্পটের জায়গাটাও বন্দরের। পর্যটকদের জন্য মংলা নদীর এই পাড়ে (বন্দর পাড়ে) ভালো ঘাট, টয়লেট, বসার স্থানসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়ানোর প্রয়োজন। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।
মংলায় পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ব্যাপারে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, পর্যটন এবং বন্দর উভয় কারণেই মংলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আবাসন এবং অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মংলায় একটি সার্কিট হাউজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বসার স্থান, আধুনিক ঘাট, হোটেল-মোটেল, টয়লেটসহ অন্যান্য সুবিধাও বাড়াতে হবে।
মংলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে আধুনিক পিকনিক স্পটের মতো করে কীভাবে সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পর্যটন কর্পোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭
এসআই