ঢাকা, রবিবার, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মেশিনের চাকা ঘুরলেও, ঘোরে না জীবনের চাকা

রীনা আকতার তুলি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩১ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৭
মেশিনের চাকা ঘুরলেও, ঘোরে না  জীবনের চাকা মেশিনের চাকা ঘুরলেও, ঘোরে না জীবনের চাকা। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: মূহূর্তের জন্যও থেমে নেই তাদের সেলাই মেশিনের চাঁকা । বন বন ঘুরছে আর তার সঙ্গে চলছে ধারালো সূঁচের ওঠানামা। শ্রমিকদের চোখগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ে থাকে সেই সূঁচাগ্রের ওঠানামা সেলাই পড়া কাপড়ের দিকে।

এতটুকু হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। একটু পরপরই সূঁচের কাছাকাছি হাত বাড়িয়ে দিয়ে কাপড় সোজা করে দিতে হয়।

এই বুঝি গেঁথে যাবে তীব্র গতিতে ওঠানামা করা সুঁই। কিন্তু যায় না। অথবা যায় কখনো কখনো। তাতে তোয়াক্কা নেই... ঝুঁকি নিয়েই চলে তাদের সেলাইয়ের কাজ। কথায় কথায় অনেকেই বলেন, ওরা স্বপ্ন বোনে সেলাইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে। সে বুননে তৈরি হয় সভ্যতা টিকিয়ে রাখার পোশাক-পরিচ্ছদ। পৃথিবীটাকে রঙ্গীন ও আনন্দময় করতেই তাদের টানা ঝুঁকিপূর্ণ পরিশ্রম।

রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, শীত কিংবা গ্রীস্ম কোন কিছুতেই তাদের কাজের রোটিনে পরিবর্তন আসে না।
 
ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে তারা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। হাতে টিফিন ক্যারিয়ার । কাজে ঢুকে পড়তে হয় সময়ের কাঁটা সঙ্গে তাল রেখে। কিন্তু এই যে কাজে যাওয়া তার আগেও থাকে তাদের কাজ। ঘর গেরস্থলীর। সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠে সেগুলো সেরে তবেই কাজে যাওয়া। আর  রাতে কাজ শেষে ঘরে ফিরে বাকি কাজ শেষ করে ঘুমুতে যাওয়া। যে ঘুমের জন্য তখন বাকি থাকে মোটেই হাতেগোনা ক’টি ঘণ্টা। মেশিনের চাকা ঘুরলেও, ঘোরে না  জীবনের চাকা।  ছবি: বাংলানিউজ

এটাই প্রতিটি গারমেন্ট শ্রমিকের জীবনচিত্র। এমনটাই তাদের জীবনযুদ্ধ। দিন, মাস, বছর যায়, অনেক কিছুই পাল্টায় শুধু পাল্টায় না তাদের জীবনের গতিপথ। ফলে পাল্টায় না ভাগ্যও।

উত্তর বাড্ডার সুমন অ্যাপারেলস’র সুমি আক্তারের কথাই ধরুন না।   বরিশালের গৌড়নদী থেকে আসা বাবা হারা মেয়েটি তার ভিটেবাড়িও হারিয়েছে নদীর গর্ভে। অসুস্থ মা আর দুই ভাইকে নিয়ে ঢাকাই গন্তব্য হয় বছর তিনেক আগে। ঢাকা এসে কাজে লেগে পড়ে। অনেকের মতো তারও সুযোগ মেলে গার্মেন্ট কারখানায়। দিনে দিনে কাজ বাড়ে, নিজেরও দক্ষতা বাড়ে কিন্তু বেতন বাড়ে না। সেই যে শুরু হলো ছয় হাজার টাকায় মাসযাপন। আজও সেই যুদ্ধ।
 
সুমির অভিযোগ, তার সঙ্গে বা আরও পরে যোগ দেওয়া অনেক পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় তাকে অনেক কম বেতন দেওয়া হচ্ছে তাকে। সুপারভাইজারকে বেতন বাড়ানোর কথা বললে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন।   গালিগালাজও জোটে। আর যখন তখন ছাঁটাইয়ের হুমকিতো আছেই।

উত্তর বাড্ডায় সুমন অ্যাপারেলসের সামনে  সুমির মত আরও কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙে কথা হল। তাদের প্রায় সকলেই বেতন বৈষম্যের অভিযোগ করলেন।
 
মেশিন অপারেটর আছিয়া বলেন, সেই পাঁচ বছর আগে গার্মেন্টেসএ কাজ শুরু করেছি। হেলপার হিসাবে শুরু করি। গত বছরে মেশিন অপারেটর হয়েছি। কিন্তু হলে কি হবে? আমার বেতন এখন মাত্র আট হাজার টাকা। কিন্তু আমাদের অফিসে ষোলজন পুরুষ মেশিন অপারেটর আছে তাদের কারো বেতনই ১৩ হাজার টাকার কম না। মেশিনের চাকা ঘুরলেও, ঘোরে না  জীবনের চাকা।  ছবি: বাংলানিউজ
 
সুমি বলেন, ‘শুনছি আমাদের কাপড় নাকি বিদেশে যায়। এছাড়া দেশেও অনেক বিক্রি হয়। মালিকরা ভালো ব্যবসা করেন। কিন্তু আমাদের ঠিক মতো বেতন দিতে চান না। যে কাজ করি তার অর্ধেক বেতন দেন।
 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অপনাদের কাপড় পরেন । আপনি কি জাননে, জিজ্ঞাসা করতেই মুচকি হাসেন সুমি। বলেন জানি তো। শুধু সেই না। পৃথিবীর অনেক নামী দামী মানুষই আমাদের হাতে বানানো পোশাক পরে। তাতে আমাদের জীবনে কিছুই যায় আসে না। সেই মেশিনের হেলপার আছি হেলপারই থাকতে হবে কয়েক বছর। বেতনও বাড়বে না। ন্যায্য পাওনা পাবোনা।

এই গার্মেন্টেসের আরেক কর্মী মমতা বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর কাজের খোঁজে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসেন। প্রতিদিন ১২ ঘন্টা কাজ করে ১৫০ টাকা মজুরি পান।
 
মমতা জানান, যে বেতন পান তা দিয়ে বাবা-মা ভাই বোনের ৮ জনের সংসার চলে না। কোনো মতে তিন বেলা খাওয়া চলে। পেটের দায়ে কাজ করেন মমতা।
 
মমতা ও সুমির দাবি, ১২ ঘন্টা কাজের বিনিময়ে তারা যে পারিশ্রমিক পান তা খুবই সীমিত। তারা তাদের কাজের স্বীকৃতি চান সঠিক মূল্যায়ন চান।
 
সরকার ও মালিকদের কাছে তাদের নিরাপত্তা ও কাজের ন্যায্য মজুরি দাবি করেন এই দুই নারী শ্রমিক।
 
বাংলাদেশ সময়: ০১২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৭
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।