২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হলেও গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯ মার্চ। ওই দিন অস্ত্র কেড়ে নিতে গিয়ে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন হুরমত আলী, ও কানু মিয়া (চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েকদিন পর মারা যান)।
ওইদিন যুদ্ধে নিহত হুরমত আলী, নেয়ামত আলী, মনু খলিফা ও কানু মিয়া শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি পাননি যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত গাজীপুরের তিন মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ কুমার মল্লিক, ইউসুফ আলী সরকার ও মো. শাহজাহান মিয়া ওরফে সামসুর রহমান। তারা পাননি রাষ্ট্রীয় সম্মানও। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ মার্চ গাজীপুরবাসীর জন্য একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের মানুষ ঘরে বসে মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল। তখন দেশের প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন ছাত্র ও উদীয়মান ফুলবল খেলোয়াড় সন্তোষ কুমার মল্লিক। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনা পেতে হাজির হয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। এক পর্যায়ে জানতে পারলেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা গাজীপুর (জয়দেবপুর) রাজবাড়িতে অবস্থিত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালি সৈনিকদের ১৯ মার্চ নিরস্ত্র করবে। তরুণ সন্তোষ কুমার ১৯ মার্চ সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যান। শিমুলতলী মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সামনে থাকা লোকজনদের সাথে যোগ দেন মিছিলে। মিছিলটি শিমুলতলী-জয়দেবপুর পথ ধরে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বর্তমান মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে জয়দেবপুরে চলা মিছিলে। মিছিলটি জয়দেবপুর বটতলা পেরিয়ে বর্তমান পোস্ট অফিসের সামনে যায়। তখন পাকিস্থানি বাহিনীর সাথে প্রথমে তাদের হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে থাকা অস্ত্র ছিনিয়ে নেন জয়দেবপুরের কিশোর নেয়ামত আলী। এরপর ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নির্দেশে মিছিল লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সেনারা বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। এসময় নেয়ামত আলী ও মনু খলিফা গুলিতে শহীদ হন। পিছু না হটে বাঙালি ছাত্র-তরুণরা তখন নিজেদের কাছে থাকা ইট, পাথর, দেশীয় অস্ত্র ছুড়তে থাকেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর।
সেদিন সন্তোষ কুমার মল্লিক আরো অনেকের মতো হাতে একটি লোহার রড নিয়ে বুক চিতিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি গুলি সন্তোষ কুমার মল্লিকের পায়ে লাগে। সেই সাথে আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। পরে কয়েকজনকে আহত অবস্থায় প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় সৈয়দ বকস ভুঁইয়ার জয়দেবপুরের চেম্বারে। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই হাসপাতালে হানা দিতে পারে খবর পেয়ে চিকিৎসার এক মাস পর সন্তোষ কুমার মল্লিক পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ওই সময় চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৫০০ টাকা শেখ আব্দুল আজিজ হাবিবুল্লাহ এনে দেন সন্তোষ কুমার মল্লিককে। এ অবস্থায় কয়েকবার যুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েও পারেননি তিনি। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ না হলেও গাজীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন তিনি। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত ১৯ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সব সময় দাওয়াত করা হয় তাকে। সন্তোষ কুমার মল্লিক জয়দেবপুরের শিমলতলী চত্বর এলাকার মৃত যোগেশচন্দ্র মল্লিকের ছেলে।
২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলেও মুলত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন এরও আগে ----৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণে। যেই ভাষণেই বাঙালি জাতি বুঝতে পারে তাদের করণীয় কি। ৭ই মার্চ থেকে বাঙ্গালী জাতি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরো জোড়দার করতে থাকে।
সন্তোষ কুমার মল্লিক জানান, ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ আমি তখন ছাত্র ও উদীয়মান ফুটবল খেলোয়াড়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে গিয়েছিলাম রেসকোস ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে। পরে ১৯ মার্চ প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়ে ডান পায়ে গুলি লেগে আহত হই। আমিসহ আরো দু’জন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাইনি। জীবনে শেষ সময়ে এসে আমি চাই, যেন আমাকেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটাই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার একমাত্র চাওয়া।
তখনকার তরুণ (বর্তমান ওষুধ ব্যবসায়ী) ইউসুফ আলী সরকারও ওই প্রতিবাদ মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন সন্তোষের পাশে। একই সময় তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। তার ঊরুতে দু’টি গুলি লাগে। তিনি ও সন্তোষ কুমার মল্লিক একই সঙ্গে টাঙ্গাইল কুমুদিনী হাসপাতলে চিকিৎসা নেন। পরে তিনিও হাসপাতাল ছাড়েন। একটু সুস্থ হয়ে তিনি নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিভিন্ন অপারেশনে যোগ দেন। ইউসুফ আলী সরকার জীবনের শেষ ভাগে এসে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটি চান। যেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিয়ে মরতে পারেন। ইউসুফ আলী সরকার জয়দেবপুরের পাজুলিয়া এলাকার বাসিন্দা।
সন্তোষ কুমার মল্লিক ও ইউসুফ আলী সরকারের মতো ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন সে সময়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র মো. শাহজাহান মিয়া ওরফে সামসুর রহমান। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে তার ডান হাতের কনুইয়ের নিচের হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। কুমুদিনি হাসাপাতালে চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ না হতেই নিরাপত্তার কথা ভেবে ২৭ এপ্রিল রাতে তিনি হাসপাতাল ছাড়েন। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে সুচিকিৎসা নিতে পারেনি তিনি। তাই হাতটি তার পঙ্গু হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও হাতের হাড়টি আর জোড়া লাগেনি। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান তিনিও। জীবনের অন্তিম সময়ে এসে যেন গর্ব করে বলতে পারেন, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনালগ্নের চিহ্ন এই পঙ্গু হাত। মো. শাহজাহান মিয়া ওরফে সামসুর রহমান জয়দেবপুর শিমুলতলী এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
ইউসুফ আলী সরকার ও শাহজাহান মিয়া ওরফে সামসুর রহমান জানান, তারা ১৯ মার্চ প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাদের জোর দাবি, তারা যেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান। সরকার যেন তাদের সম্মানের সাথে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেন। এলাকার সবাই ১৯ মার্চের ঘটনা জানেন। কিন্তু কাগজকলমে নেই তাদের নাম। নেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি।
সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ঠিক সেই সময় ১৯ মার্চ একদল বীর সন্তান জয়দেবপুরে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। সেই প্রতিরোধে নিজের জীবন দিয়ে বাংলার মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন কিশোর নেয়ামত আলী, মনু খলিফা, হুরমত আলী, ও কানু মিয়া। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন সন্তোষ কুমার মল্লিক, ডাঃ ইউসুফ আলী সরকার ও মো. শাহজাহান মিয়া ওরফে সামসুর রহমানসহ আরো অনেকে।
এব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলেন, সন্তোষ কুমার মল্লিক, ইউসুফ আলী সরকার ও মো. শাহজাহান মিয়া প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে ছিল একথা সত্য। কিন্তু যারা ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে বা মারা গেছে, তাদেরকেই কেবল মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে অনেকেই আহত এবং শহীদ হয়েছেন। তাদের মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এই তিনজন তো ২৬ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৭
আরএস/জেএম