ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ মাঘ ১৪৩১, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলানিউজকে সুন্দরী বালা

মরা মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিলাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
মরা মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিলাম বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে সুন্দরী বালা- ছবি- মানজারুল ইসলাম

খুলনা: খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে একাত্তরে সংঘাটত গণহত্যার জীবিত সাক্ষী সুন্দরী বালা। সেই ভয়াল ও বীভত্স গণহত্যাস্থলে মৃত মায়ের বুকে দুধ পান করার চেষ্টা করছিল মাস ছয়েকের শিশু সুন্দরী বালা। সেই শিশুটি নানা বিঘ্ন, বাধা পেরিয়ে  জীবনের ৪৬ বছর পার করেছেন। 

বুধবার (২৯ মার্চ) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সেদিনের সেই সুন্দরী বালার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

সুন্দরী বালা বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালের ২০ মে আমি আমার মরা মায়ের বুকের উপরে দুধ খাচ্ছিলাম।

এরশাদ দাদা আমাকে কুড়িয়ে এনে এক হিন্দু পরিবারের কাছে দেয়। পরে তারা আমায় লালন-পালন করে, বিয়ে দেয় বাটুল দাশের  সঙ্গে।  আমার দুই ছেলে সুমন সরকার ও ডেভিড সরকার। অর্থের অভাবে ওদের লেখাপড়া করাতে পারিনি। খুব কষ্ট-যন্ত্রণায় দিন যেত আমার। আমি মাঠে কৃষিকাজ করতাম। দিনমজুরিতে পেটে-ভাতে চলত না। পরে স্বামী মারা গেলে আমি ইটের ভাটায় চলে গেলাম। ইটের ভাটায় আমি চার বছর কাজ করেছি। অনেক কষ্ট পাইছি আমি। দিনে মাত্র একশত টাকা মজুরি ছিল আমার।

সুন্দরী আরো বলেন, ইটের ভাটায় কাজ করার কষ্টের চিত্র সাংবাদিকেরা তুলে ধরেন। সাংবাদিকেরা না গেলে আমি কিছুই পেতাম না। সাংবাদিকদের  লেখালেখির কারণে আমি ডুমুরিয়া উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ৮ হাজার টাকার মাস্টার রোলে একটা ছোটখাট চাকরি করছি।  চাকরিটা স্থায়ী হলে ভালো হতো।  

চুকনগর বধ্যভূমিএরশাদ আলীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, সেদিন এরশাদ দাদা আমাকে কুড়িয়ে না আনলে আমি হয়তো বাঁচতামই না। তিনি শুধু আমাকে কুড়িয়েই আনেননি, মায়ের কপালে সিঁদুরের চিহ্ন ও হাতের শাঁখা দেখে  হিন্দুঘরের সন্তান বুঝে হিন্দু পরিবারে বড় করিয়েছেন। আজ আমাকে অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলামের সহায়তায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী শিল্পকলা একাডেমিতে একটি চাকুরি দিয়েছেন। লেখাপড়া না জানা মানুষকে তারা যে মূল্যায়ন করেছেন, সেজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

সুন্দরী জানান, এই সরকারের আমলে ১১ শতক জমি তাকে দেয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে জমির দলিলও। তিন শতক জমির দখল পাওয়া গেছে। বাকিটা স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। যে জমি দেওয়া হয়েছে তার গর্ত ভরাট করার মতো টাকা না থাকায় ঘর করতে পারছেন না। এখনো তাই ডুমুরিয়ায় ভাড়াঘরে থাকতে হচ্ছে।  

‘চুকনগর বধ্যভূমিতে গেলে আজও বুকটা হাহাকার করে ওঠে। খুঁজে ফিরি মা-বাবাকে। কিন্তু আমি তো জানি না আমার পৈত্রিক বাড়ি কোথায়। শুধু জানি, বাঁচার আশায় আমার পরিবার এখানে এসেছিল। ’—একথা বলে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন সুন্দরী বালা।  

উল্লেখ্য, পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, চুকনগরের গণহত্যা সেসবের একটি। ১৯৭১ সালের ২০ মে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুলনার ডুমুরিয়ার ছোট্ট শহর চুকনগরে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। অতর্কিত হামলা চালিয়ে মুক্তিকামী ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে তারা। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে চুকনগরের গণহত্যা এক ভয়াবহ কালো অধ্যায়।  
সুন্দরী বালাসেদিন যাদের হত্যা করা হয়, তাদের বেশির ভাগ পুরুষ হলেও বহু নারী ও শিশুকেও হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। অনেক শিশু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল। সেই অবস্থায় গর্জে ওঠে ঘাতকের কামান। ঘাতকের বুলেট মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন মা। কিন্তু অবুঝ শিশু সুন্দরী বালা তখনও অবলীলায় মায়ের স্তনে মুখ রেখে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত।  এমন কত ঘটনা যে সেদিন ঘটেছিল তার সঠিক ধারণা পাওয়া আজ কঠিন।

খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, গোপালগঞ্জ থেকে হাজার হাজার বাঙালি নৌপথে ও হেঁটে আসতে থাকে চুকনগরে। এ আসা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে অনেক বাঙালি সীমান্তের ওপার ভারতে চলে যান। ২০ মে ১৯৭১। চুকনগরে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাঙালিরা অপেক্ষা করতে থাকে ভারতে পাড়ি দেয়ার জন্য। প্রতিদিনের মতো আগের দিন চুকনগরে আসা বাঙালিরা আশ্রয় গ্রহণ করে ওই এলাকার স্কুলঘরে, বাজারে, পাশে পাতোখোলা বিলের ধারসহ বিভিন্ন স্থানে। এই পলায়ন শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য ছিল না। অনেকের লক্ষ্য ছিল ভারতে গিয়ে স্বদেশ ভূমিকে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনির হাত থেকে মুক্ত করবেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রগ্রহণের জন্য নাম লেখাবেন।  

২০ মে। সকালবেলায় প্রত্যেকেরই ভারতের উদ্দেশে রওনা হওয়ার প্রস্ততি চলছে। এর মধ্যে সকাল ১০টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনির দুই/তিনটি গাড়ি এসে থামে পোতোখোলা বিলের পাশে। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালিদের (বিহারি) সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনি শুরু করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি বাহিনির সৈন্যসংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সম্ভবত এক প্লাটুন। ট্রাক থেকে নেমে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনি এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি কর্মমুখর ও ব্যস্ত এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শুধু মৃত শরীরের স্তুপ। মৃত শিশু মৃত মায়ের কোলে, বাবার কোলে। স্ত্রী তার স্বামীকে জড়িয়ে। এরকম চিত্র সেদিনের হত্যাযজ্ঞে, দেখতে পাওয়া যায়। এই গণহত্যার পাশাপাশি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনি যুবতী নারীদের ধর্ষণ করে। এছাড়াও অনেক বাঙালিকে নিকতবর্তী পাকিস্তানি বাহিনির ক্যাম্পে নিয়ে পরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। আবার যারা আহত হয়েছিল তাদের বর্বর পাকিস্তানিরা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ভদ্রা নদীতে লাশ ফেলার দায়িত্ব দেয়া হয় অনেককে। প্রতি লাশের জন্য ৫০ পয়সা দেয়া হবে এমন ঘোষণাও দেয়া হয়। লাশের গায়ে যেসব লাশের সঙ্গে নগদ অর্থকড়ি, গয়না, সোনাদানা পাওয়ার কারণে গুনে গুনে নদীতে লাশ ফেলাটা গুরুত্ব হারায় লাশ ফেলার কাজে  নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে।  
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
এমআরএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।