এই যেমন মনোজ কান্তি পাল। ধ্যানমগ্ন কাজ করছিলেন।
তার সৃষ্টিশীল কাজে আগে দরকার কাদা প্রস্তুত করা। পণ্যের মাপ বুঝে কাদা চাকার মাঝখানে রাখা হয়। এরপর পণ্যের পুরো অবয়ব ফুটে ওঠা পর্যন্ত ঘুরতে থাকে চাকা। সঙ্গে চলতে থাকে মনোজ কান্তি পালের হাতের কারিশমাও। চাকা ঘুরতে ঘুরতে এক সময় নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে একেকটি আকর্ষণীয় শিল্প।
শুরু হয় শুকানোর পালা। শুকানো শেষ হলে পণ্যগুলো স্তূপ আকারে সাজানো হয়। নির্ধাতির স্থানেই চুল্লি করা হয়। সেই চুল্লিতে তৈরি পণ্যগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়। শেষে করা হয় পরিষ্কার।
রকম বুঝে পণ্যের গায়ে রঙ মাখাতে তুলির ছোঁয়া লাগে। এরপর সেগুলো প্যাকেটজাত করা হয়। পরে তৈরি সব পণ্য বাজারে উঠানো হয়। এরমধ্যে অনেক পণ্য অর্ডার অনুযায়ী বাড়ি থেকে নিয়ে যান ক্রেতারা। আবার অনেক পণ্য ব্যবসায়ীর ঠিকানায়ও পৌঁছে দেওয়া হয়।
প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাতে পর্যন্ত কুমোর পল্লিতে চলে নারী-পুরুষের কর্মযজ্ঞ। অন্য পেশা জানা না থাকায় বংশ পরম্পরায় এ পেশাকেই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ধরে রেখেছেন মৃৎ শিল্পীরা। তারা এ শিল্পেই টিকে থাকার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বগুড়ার সদর, গাবতলী, শাজাহানপুর, শেরপুর, কাহালু উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে কয়েক হাজার মৃৎ শিল্পী বসবাস করেন। অভাবের সঙ্গে আপোস না করে গ্রাম বাঙলার ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ পেশাকে ভালোবেসে অনেকে আজও করে যাচ্ছেন কাজ।
নয়ন পাল, রতন পাল, শিশির পাল, গোবিন্দ পালসহ একাধিক কুমোর শিল্পী স্থানীয় ভাষায় বাংলানিউজকে জানান, আগের দিন বাঘে খেয়েছে! সুদিন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। অন্য কাজও জানেন না। বয়সও অনেক হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে হলে তো কিছু একটা করতে হবে। তাই বাপ-দাদার কাছে শেখা মাটির সামগ্রী তৈরির কাজ করছেন তারা।
তারা আরও জানান, মাটির কলসি, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, পেয়ালা, দইয়ের সরা, ছাইদানি, ফুলদানি, মূর্তি, পাখি, তৈজসপত্র, ফুল, ফল, সোপিস, পুতুল, খেলনা, সুরাই, মঠক, সানকি, কড়াই, ঠিলা, পিঠা তৈরির নানা ধরনের ছাঁচসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মানুষের বাসাবাড়িতে আগে খুব বেশি শোভা পেতো। মানুষের কাছে মাটির তৈরি এসব জিনিসপত্রের কদর ছিল ব্যাপক। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব জিনিসের ব্যবহার ব্যাপক হারে কমেছে। গ্রামের মানুষ কিছু জিনিসপত্র ব্যবহার করলেও শহর এলাকায় এসবের ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত। তবে দইয়ের সরা ও হাঁড়ি-পাতিলের কদর কমেনি বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর তাতেই আশার আলো দেখছেন জেলার কুমোর শিল্পীরা। কারণ বগুড়া দইয়ের জন্য খ্যাত। প্রতিদিন শতশত মণ দই তৈরি হয়। দই মাটির তৈরি এসব পণ্যে ভরতে হয়।
মনোজ কান্তি পাল, সুবোদ পাল, সুর্বনা পাল বাংলানিউজকে জানান, পূজো, নববর্ষসহ বিভিন্ন মেলায় এখনও মাটির তৈরি জিনিসপত্রের বেশ চাহিদা রয়েছে। সময়গুলোতে মাটির তৈরি প্লেট, খেলনা, হাতি, ঘোঁড়া, বাঘ, মাছ, আম, কাঁঠাল, পুতুল, ব্যাংক, খুটি, মালসাসহ নানা ধরনের সামগ্রী বেশ ভালো বিক্রি হয়। দামও ভালো পাওয়া যায়।
সবমিলিয়ে এসব মৃৎ শিল্পীরা এ শিল্পকে নিয়ে এখনও আশার আলো দেখছেন। তবে তাদের সামনে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থ। সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ দিতে চায় না।
সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পাওয়া গেলে গ্রাম বাঙলার ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ শিল্পকে এখনও ভালোভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। এতে তাদের এ পেশা ছেড়ে দিতে হবে না বলেও মনে করেন এসব কুমোর শিল্পীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
এমবিএইচ/আইএ