সুনশান নিরবতা আর গ্রামীণ সৌন্দর্য নিয়ে পল্লীকবির কবিসত্তার নানান স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে আছে বাড়িটি। গ্রামীণ পরিবেশ, সামনে কুমার নদের নির্মল হাওয়া প্রাণ জুড়াবে যে কারোর।
‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায়, লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়...’
ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর রেলস্টেশনের উত্তরে কুমার নদের দক্ষিণে গোবিন্দপুর গ্রামে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি।
বাড়ির প্রবেশমুখেই রয়েছে পল্লীকবির একটি ম্যুরাল। নিচে লেখা:
‘আমার বাড়ী যাইও ভ্রমর; বসতে দিব পিঁড়ে
জলেপান যে করতে দিব; শালি ধানের চিড়ে। ’
বাড়িতে অতিথি ভ্রমরকে জলখাবার দেয়ার জন্য কবি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার বাড়িতে অতিথি হয়ে আসবার সকাতর নিমন্ত্রণ। আছে তার কালজয়ী আবেদনময় কবিতার চরণ আর স্মৃতিচিহ্ন, অভিজ্ঞান।
বাড়ির উত্তর দিকটায় প্রবেশমুখেই ডান দিকে রয়েছে পল্লীকবির পারিবারিক কবরস্থান। তাঁর রচিত ‘কবর’ কবিতার শুরুটা ছিল এমন:
‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’
ডালিম গাছের তলেই এখন ঘুমিয়ে ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’-এর কবি। সারা বাড়িজুড়ে তবু তারই অশরীরর উপস্থিতি। সবখানে যেন ‘নেই তিনি’ আছেন। সেটি হচ্ছে তাঁর কালজয়ী কবিসত্তার প্রবল উপস্থিতি—মনের ভেতর ঘুরতে থাকা তার কবিতার একের পর এক চরণ। নয়ন সুমুখে না থেকেও তিনি যেন নয়নের মাঝখানে নিয়েছেন ঠাঁই।
একটু এগোলেই হাতের ডানে পড়বে কবির আমলের সেই কাছারি ঘর।
এবার একটু বাঁয়ে মোড় নিতেই চোখে পড়ল ছোট্ট উঠান। এবার চোখে পড়ল পল্লীকবির ঘরটি। যেখানে শুয়ে বসে কবি রচনা করে গেছেন তার অমর সৃষ্টি কবর ‘কবিতা’। রাখালী, নক্সীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট-এর মতো কাব্য।
বাড়ির উঠোন ঘিরে চারটি ঘর। কবি ঘরের ডান পাশে তাঁর বড় ভাই, এরপর সেজো ভাই আর বাম দিকে রয়েছে কবির বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের ঘর।
বাড়িতে ছোট বড় আরো কয়েকটি ঘর রয়েছে। কোনোটি রান্নাঘর, কোনোটি ঢেঁকিঘর।
বাড়ির পিছনে দিকে রয়েছে কবির হাতে লাগানো সফেদা গাছ। কবির ঘরসহ প্রতিটি ঘরে সাজানো রয়েছে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, তার সৃষ্ট সাহিত্যের অংশ বিশেষ, নানা সময়কার দেশে বিদেশে তোলা স্থিরচিত্র, বিভিন্ন পুরস্কার, মেডেলসহ নানান স্মৃতিচিহ্ন।
কবির বাবা-মা ও ছোট ভাই যে ঘরটিতে থাকতেন এই ঘরটি ছাড়া অন্যসব ঘরই টিনের চালাঘর। এই ঘরটিতে সংরক্ষিত রয়েছে কবির ব্যবহৃত ঘড়ি, ক্যামেরা, গ্রামোফোন, টাইপ রাইটার এবং তৈজসপত্র।
পল্লীকবির বাড়ি সামনে কুমার নদের তীরে রয়েছে জসীমমঞ্চ। এখানে প্রতিবছর জসীমমেলা হয়ে থাকে। বাড়ি থেকে কয়েক’শ গজ দূরে নির্মাণ করা হয়েছে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সংগ্রহশালা। যেখানে রয়েছে গ্যালারি, লাইব্রেরি,উন্মুক্ত মঞ্চসহ আধুনিক সুযোগ সুবিধে। বুধবার (২৯ মার্চ) বিকেলে ফরিদপুরে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির উদ্বোধন ও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এই সংগ্রহশালাটিরও উদ্বোধন করেন।
পল্লীকবি ১৯০৪ সালের ১ জানুয়ারি দিনের বেলা ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের তাম্বুলখানা গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ জীবনাবসান হয় তাঁর।
‘ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে’, ‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও’ কিংবা ‘আমার এ-ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর’--–গ্রামবাংলার প্রাণের সঙ্গে মিশে থাকা এরকম স্মরণযোগ্য কতো যে চরণ তিনি রেখে গেছেন, বাংলার অবারিত মাঠ-ঘাট-নদীর প্রাণমাতানো যে আলেখ্য তিনি রেখেছেন তা চিরকাল তুলনারহিত।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
এমইউএম/জেএম