‘আজকে ইংরেজি মাসের কত তারিখ’?
এই প্রশ্নটির জবাবে শতভাগ সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব।
অথচ আশ্চর্যজনক বিষয এটাই যে, ইংরেজি ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালাই নেই, রোমান হরফ ধার করে এ আন্তর্জাতিক ভাষাটি গড়ে উঠেছে।
![ছবিতে বাঁয়ে নাগরী, ডানে বাংলা বর্ণমালা](http://www.banglanews24.com/media/imgAll/2016October/bg/220170413200915.jpg)
পক্ষান্তরে সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত প্রায় চার হাজারেও অধিক ভাষার মধ্যে যে দেড় শতাধিক ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে, বাংলা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান, প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। হালের বিশ্বে বাংলা ভাষার অবস্থান সপ্তম স্থানে। নিজস্ব ৫০ হরফের বর্ণমালা ছাড়াও সিলেটী নাগরী নামে ৩২ হরফের আরেকটি অগ্রসর বর্ণমালাসহ মোট দু’টি স্বতন্ত্র বর্ণমালার অধিকারী আমাদের বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার গৌরবের মতোই বাংলার সাংস্কৃতিক অহংকার হল বাংলা সাল।
ইতিহাসের ভাষ্য মতে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসন (১৩৩৮-১৫৩৮) পরবর্তীকালের পাঠান, আফগান ও ঈসা খানের নেতত্বাধীন বারো ভূইয়া শাসনের অস্থির ধারাবাহিকতায় মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলার খাজনা আদায়ের বিষয়টিকে একটি বিশৃঙ্খল, জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দেখতে পান। রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও চান্দ্র মাসভিত্তিক সাল গণনায় দেখা যায় যে, বছরে ১০-১১ দিন করে কমে মাসগুলো ক্রমান্বয়ে সারা বছরে আবর্তিত হতে থাকে। অথচ খাজনাদাতা কৃষিজীবীর জমির ফসল কিন্তু মৌসুম মতই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই উৎপন্ন হয়। এতে খাজনা আদায়ের বার্ষিক সিডিউল প্রতি বছরই পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। একাদশ শতাব্দীতে একই সমস্যা দেখা দিয়েছিল পারস্যের মালিক শাহের রাজত্বে। মালিক শাহের সভাকবি ওমর খৈয়াম পণ্ডিত নিশাপুরীর মাধ্যমে চন্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তরিত করে সমস্যাটির সমাধান করেন। সম্রাট আকবরও বাংলাসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে কতিপয় ‘ফসলি সাল’ প্রবর্তন করেন। বাংলা বর্ষ আকবর প্রবর্তিত সেইসব ফসলি সালের একটি।
সম্রাট আকবরের দরবারের বিখ্যাত ’নবরত্ন সভা’র বাইরেও অনেক মেধাবী-পণ্ডিত ছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম আমির ফতেহ উল্লাহ শিরাজি, তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন বর্ষ প্রণয়নের। শিরাজি সম্রাটের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা টোডরমলের সহকারীরূপে কাজ করতেন। টোডরমলকে ভূমি রাজস্ব, খাজনা ও অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনায় সহযোগিতা করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বীয় যোগ্যতায় সম্রাটের অর্থ বিভাগের প্রধান বা সদর পদে উন্নীত হন। শিরাজি আকবরের কাছ থেকে ’আমিন-উল-মুলক’, ’আসাফ-উদ- দৌলা’, ’রোস্তম সানি’ ইত্যাদি উপাধি লাভ করেন।
সব দিক বিবেচনা এবং সমন্বয় সাধন করে শিরাজি আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরিকে ভিত্তি বছর ধরে একটি সাল প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হিজরি সালের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত শকাব্দ থেকে মাসের নামগুলো নেওয়া হয় নতুন সালে। এতে চান্দ্রভিত্তিক ১ হিজরি থেকে ৯৬৩ হিজরি পর্যন্ত পুরো সময়কালকে অপরিবর্তনীয় ধরে ৯৬৩ পরবর্তী সময়কালকে সৌর গণনা পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করা হয়। মজার ব্যাপার হল, এই বাংলা বর্ষটি ১ সাল থেকে শুরু হয়নি। বরং যে বছর চালু হল, সে বছরের হিজরি সাল অনুযায়ী বর্ষটির শুরু ৯৬৩ সাল থেকে। চান্দ্র ও সৌরবর্ষের সমন্বয়ে তৈরি এই ক্যালেন্ডার স্বভাবতই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে পিছিয়ে পড়ত। এই গড়মিল ঘোচানোর জন্য ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমী একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে। শহীদুল্লাহ-কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী সংস্কার সাধন করে এই বর্ষে ৩৬৫ দিন রাখা হয় এবং বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) ৩১ দিন করে এবং শেষ সাত মাস (আশ্বিন থেকে চৈত্র) ৩০ দিন করে ঠিক করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অধিবর্ষে (লিপইয়ার) বাংলা ক্যালেন্ডারের ফাল্গুন মাসে এক দিন বাড়তি যোগ করা হয়। আধুনিক এই বাংলা ক্যালেন্ডার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যান্য প্রদেশে তা গ্রহণ করা হয়নি।
আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পরও এই বাংলাদেশেই অন্যতম প্রচলিত ক্যালেন্ডার ছিল শকাব্দ বা শালিবাহন বর্ষ। ঠিক কোন সময় থেকে এই বর্ষ চালু হয়, তা নিয়ে অনেক বির্তক রয়েছে। কেউ বলেন, শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর দিন থেকে শকাব্দ গণনা শুরু।
আল-বিরুনির মতে, এই বর্ষ চালু করেন রাজা বিক্রমাদিত্য। তিনি এক যুদ্ধে কোনো এক রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করার প্রসঙ্গটি স্মরণীয় করে রাখতেই নাকি কাজটি করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, শক-বংশজাত কুশান রাজা কনিষ্ক এই সাল প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ব্যাপার হল, একই সঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তে দুই নিয়মে শকাব্দ প্রচলিত ছিল। পশ্চিম ভারতে শকাব্দ পরিচালিত হত চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। আর পূর্ব ভারতে শকাব্দ চলে সৌরবর্ষ অনুযায়ী। বাংলা বর্ষটি চান্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ভারসাম্য আর সমন্বয়ের প্রতিফল।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৭
জেডএম/