তার স্বামী ধনপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি পরেশ গোপ এ মুহূর্তে গ্রামে নেই। কথাটা তাই বাতাসেই ছুঁড়লেন সুকৃতি।
হাসি-তামাশায় আর খুব বেশী চাঙ্গা হয় না এ গ্রামের মানুষ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্বেগ এসে বারবার চেপে ধরে স্বপ্নভাঙা জীবনের টুঁটি।
ওদের আনন্দ ভেসে গেছে চৈত্র মাসের অকাল ঢলে। চারিদিকে থই থই পানির মাঝে দ্বীপ হয়ে যাওয়া গ্রামটার চারিপাশ থেকে উঠে আসে ডুবে যাওয়া ফসলের দু:স্বপ্ন।
পল্লী বিদ্যুতের খুটি এসে কেবল থেমেছে গ্রামটার কাছে। ক’দিন পরই বিদ্যুতের আলো জ্বলতো প্রত্যন্ত সহিলায়। কিন্তু সদ্য ফুটতে থাকা আলোর শরীরে নিকষ অন্ধকার লেপে দিয়েছে রাতারাতি ধানক্ষেত গিলে খাওয়া অকাল ঢলের পানি।
ওই পানিতে ফসল তো গেছেই, খাওয়ার জন্য গ্রামটার ঢালে ঢালে রোপন করা লাল শাক, ডাঁটা শাক, ঢেঁড়স, পাটশাক আর মরিচের কচি গাছগুলোও ডুবলো বলে।
এমন মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে বিদ্যুতের খুঁটিটার উত্তরে কেবল দাঁড়িয়ে রয়েছে সোয়াশ’ বছরের স্কুলটা। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত সহিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিই নাকি ইটনা উপজলার সবচে’ পুরনো স্কুল।
সেটার সামনেই বসেছে ঘোষপাড়ার ঘোষদের জটলা। পরেশচন্দ্র ঘোষ ২০ একর, অবিনাশ ঘোষ ৩ একর, অমৃত লাল গোপ ১৫ একর আর হরিনাথ দাস ১ একর জমির প্রায় পেকে আসা ধান পানির নিচে হারিয়ে হা হুতাশ করছেন। হাওর বধূরাও জড়ো হয়ে গেলেন অনাগত অতিথিদের একনজর দেখতে। ছুটে এলেন নিয়তি রাণী। অকালে বিধবা হওয়া নিয়তির নিয়তিও ওই ঢলের জলেই ভেসে গেছে।
৯০ বছর বয়সী নরেন্দ্র ঘোষ বললেন, চৈত্র মাসে বর্ষা হয় না। এমন বর্ষা আমার বাপ দাদাও দেখেনি। একদিনেই চোখের সামনে সব ডুবে গেলো।
গোপাল চন্দ্র বললেন, গ্রামের চারিদিকে ধানের গাদা থাকতো এ সময়। আর এখন পানি আর পানি।
ঘোষপাড়ার মতোই হাহাকার দানা বেঁধেছে নোয়াহাটির নূরে আলম, কাচারি পাড়ার হাদিস মিয়ার বুকে। পানির পানে তাকিয়ে মাহবুবুর রহমানের স্বগতোক্তি, জীবিকা নির্বাহ কিভাবে করবো সেটাই চিন্তার বিষয়।
গ্রামের পশ্চিম ঘেঁষে বয়ে গেছে ধনু নদী। ওই নদী পথে ভাটির দিকে ৫ কিলোমিটার গড়ালে ইটনা উপজেলা সদর। পূর্বে মৃগা, লাইম পাশা, উত্তরে ধনপুর, পশ্চিমে বরশিপুর, থানেশ্বর, আরাইলা আর গণকপুর।
সহিলা নামে এই লম্বাটে দ্বীপ গ্রামটায় পাড়া আছে মোট ৬টা। ঘোষপাড়ার উত্তরে সবার উত্তরে পুরান কাঠি, তারপর বড়হাটি। ঘোষ পাড়ার দক্ষিণে কাচারিপাড়া, তারপর নয়াহাটি সর্ব দক্ষিণে। পুরান হাটের পূবে কনসান পাড়া।
কনসান পাড়ার দক্ষিণে মাটি ফেলে এ বছরই তৈরি হয়েছে বিস্তৃত ধানের খলাটা (ধান শুকানোর চাতাল)। কিন্তু এ বছরই এদের ভাসিয়ে দিযেছে অকাল বন্যা। প্রায় ৮শ’ পরিবারের হাজার চারেক মানুষের হাওরের ধানেই ভরসা এখানে। এখানকার সব পবিরারই ধানজীবী। কিন্তু সেই ধান তো গেছেই, খাদ্য সঙ্কটে পড়া গবাদি পশুও বিক্রি করে দিতে হচ্ছে জলের দরে।
সব মিলিয়ে ১২ হাজার একর জমিতে চাষ করে প্রতি মৌসুমে প্রায় লক্ষ মণ ধান তোলে সহিলার মানুষ। কিন্তু এবার পানির সঙ্গে লড়ে সব মিলিয়ে এক হাজার মণ ধানও তুলতে পারেনি ওরা। এক চিলতে একটা কান্দা কেবল জেগে আছে পূর্ব দিকে। সেখানেও পচা ধানের দুর্গন্ধ।
কিন্তু এসবের কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না অবুঝ শিশুদের। নোয়াহাটি আর কাচারিপাড়ার মাঝের এক চিলতে রাস্তাটায় তাই মাটিতেই আসত পেতে মাটি নিয়ে খেলছে ওরা। দলাই মলাই করে ইচ্ছেমতো হরিণ, বাঘ আর হাঁড়িপাতিল বানাচ্ছে মাটির দলাগুলোকে। আহা!এই শিশুদের মতো যদি ইচ্ছা মাফিক গোটা হাওরটাকেই শেপ দেওয়া যেতো!
আরও পড়ুন
** তবু যদি কিছু মেলে
** গরু মরবে ঘাসে
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭
জেডএম/