ইটনার সহিলা গ্রামের পরেশ চন্দ্র ঘোষের ২০ একর জমির পুরোটাই ঋণের টাকায় আবাদ করা। ব্র্যাকের ৩০ হাজার টাকা নিয়ে মাসে ৩৩শ’ টাকা কিস্তি পরিশোধই দায় হয়ে উঠেছে রঞ্জিত সরকারের।
এমনিতেই স্মরণাতীতকালের ভয়াবহতম অকাল ঢলে ফসল হারিয়ে দিশেহারা তারা। তারওপর মাথার ওপরে ঝুলছে দাদন, এনজিও আর ব্যাংক ঋণ। অধিকাংশ কৃষক বাঁধা পড়েছেন এই তিন রকমেরই ঋণের জালে।
পানির নিচে মৌসুমের একমাত্র ফসল তথা বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে আউলা হয়ে যাওয়া মাথায় ঋণের বকেয়া বোঝাটা তাই ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসেবেই চেপে বসেছে যেনো। খোরাকির চালই যেখানে নেই, সেখানে ঋণ বা দাদন শোধ তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। হাওর শুকিয়ে গেলে প্রতি কার্তিকে ওদের ঋণ দেয় মহাজন, এনজিও আর ব্যাংক। বৈশাখে গোলায় ধান উঠলে নিজেদের খোরাকি রেখে সে টাকা পরিশোধ করে কৃষকরা। কিন্তু চলতি মৌসুমের নজিরবিহীন আগাম বন্যা সলিল সমাধি দিয়েছে ধানের গোছায় মিশে থাকা স্বপ্নকে। কে জানতো, এভাবে শরীর পোড়ানো মধ্যচৈত্রেই শুরু হবে আকাশ ভাঙা বর্ষা!
ইটনা উপজেলা মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান মাছুমা আক্তারের বক্তব্য, হাওরে এমন কৃষক নাই যে নিজের টাকায় জমি চাষ করে। সব হয় লোনে। হয় ব্যাংকের ঋণ, নয়তো এনজিওর ঋণ অথবা চড়া সুদে মহাজনের দাদন। এনজিওগুলোর মধ্যে আশা, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক আর পপিই মূলত ঋণ দেয় হাওরের ধানজীবীদের।
মহাজনের ৯০ হাজার টাকা দাদন ছাড়াও পল্লী বিকাশ কেন্দ্রের ৩০ হাজার টাকা ঋণ আছে কানুর। ব্র্যাকে রঞ্জিতের ঋণ আছে হাজার তিরিশেক। মিঠামইনের সুনীল চন্দ্র দাশের আছে ৫০ হাজার টাকার ঋণ।
দেড় একরের বাদাম, ৫ একরের ধান আর ১ একরের আলু ক্ষেত হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন ইদ্রিস মিয়াও। সুদের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ৭০ হাজার টাকা নিছি। বছরে হাজারে ৪শ’ টাকা সুদ দিতে হবে। আর আসল তো আসলই।
নিজের অসহায়ত্ব অকপটে তুলে ধরে বাংলানিউজকে সুনীল বলেন, একর প্রতি খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৫ একরে সোয়া ১ লাখ। কিন্তু ঢলের সঙ্গে লড়ে ফসল যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে একমাসও চলবে না। ঋণ শোধ তবে কী করে হবে! ঘরে তালা দিয়ে এলাকা ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় দেখছি না।
পরেশ চন্দ্র ঘোষের কথায়, গৃহস্থি উঠলে খোরাকি রাইখা ঋণ পরিশোধ করি। কিন্তু এবার তো খোরাকিই নাই। ঋণ শুধমু কেমনে! যারা লোন দিলো তারা তো আর টাকা বেশি দিন ফেলে রাখবে না।
রঞ্জিত সরকারের বক্তব্য, এখন তো কিস্তি চালানোই সংকট। এ ঋণ আর শোধ হওয়ার নয়।
এমন পরিস্থিতিতে তাই ইটনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইয়াকুব খান বলেন, দাদন নিয়া গণ্ডগোল লাগবো সামনে। সুদের কারবারিদের বেজায় দাপট। তাই হাওরের কৃষককে বাঁচাতে হলে সরকারকে অবশ্যই সুদ মওকুফের ব্যবস্থা করতে হবে।
আর আসল শোধ করতে হবে স্থানীয় উদ্যোগে। নতুবা দাদনের টাকা টানাটানি নিয়ে খুনোখুনিও শুরু হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
দাদন প্রসঙ্গে ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মসিউর রহমান খান তাই বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে দাদন ব্যবসায়ীদের বলে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেনো সুদ না নেয় এবার। এনজিও আর ব্যাংকগুলো যেন টাকা আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৭
জেডএম/এইচএ/
আরও পড়ুন
** চোখ তবু হাওরের জলে
** ডুবে যাওয়া ফসলের দ্বীপগ্রাম
** তবু যদি কিছু মেলে
** গরু মরবে ঘাসে
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে