একটি কথাতো খুবই বলা হয়, বাংলাদেশ আজ যে এগিয়ে চলেছে তার পেছনেই ১৬ কোটি জনশক্তির একটি বড় বল কাজ করে। হাটে-মাঠে-ঘাটে-পথে-প্রান্তরে, অন্দরে-বাহিরে, পাতালে-অন্তরীক্ষে আজ বেড়েছে কাজের পরিধি।
‘কঠোর শ্রম’ কথাটি নিয়ে থমাস জেফারসনের উক্তিটি এমন- ‘আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী নিঃসন্দেহে, তবে আমি এটাই দেখি- কাজটি যত কঠিন করি, ফলটি ততই ভালো পাই। ’ সুতরাং কঠোর শ্রমে পিছ পা হবার নয়।
আলবার্ট আইনেস্টাইনের কথাতো আমরা সবাই জানি। কায়িক নয়, মেধার শ্রমে বিশ্বকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছু, বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে করে গেছেন মহিমান্বিত। তিনিও কিন্তু গায়ে খাটা মানুষগুলোর প্রতি ছিলেন মর্যাদাশীল।
বলতেন, প্রতিদিন নিজেকে শতবার মনে করিয়ে দেই, এই যে ভেতরগত (নিজ মেধা ও মনন অর্থে) আর বাহ্যিক জীবনটি যাপন করে যাচ্ছি, তা স্রেফ অন্যের শ্রমের ওপরই ভর করে, তাদের কেউ জীবিত, কেউ মরেও গেছেন। তাদের কাছ থেকে যা কিছু নিয়েছি আর নিয়ে যাচ্ছি সে ঋণ পরিশোধে নিজেকেও ঠিক ততটাই নিবেদিত প্রাণ করে কাজ করতে হবে, এইটুকু বুঝি। ’ জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত নিঃসন্দেহে তা করেও যেতে পেরেছিলেন আইনস্টাইন। বরং মেধার কাজ দিয়ে পৃথিবীকেই ঋণী করে গেছেন অনেক বেশি।
শ্রমজীবী মানুষকে মহান করেই দেখতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার একটি উক্তি শুনুন- ‘আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্বিমান, ওষুধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না, নিশ্চয়ই আমার কৃষক ভাইরা পারে না। নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। ’
‘...তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে’- শ্রমজীবীদের কথা ঠিক এভাবেই বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার মধ্য দিয়ে শ্রম আর শ্রমজীবীকে মহান করেছেন তিনি।
আর জাতীয় কবি কাজী নজরুলতো তাদেরই গান গাইতে চেয়েছেন- যারা ধরণীর তলে ফসলের ফরমান এনেছেন। কুলি-মজুরের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন-
‘তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাইল ধূলি
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান
তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান’
কবি নির্মলেন্দু গুন লিখেছেন-
যতক্ষণ তুমি দৃঢ়পেশী শ্রমিকের মতো প্রতিবাদী,
যতক্ষণ তুমি মৃত্তিকার কাছে কৃষকের মতো নতমুখ,
ততক্ষণ আমিও তোমার।
আপনার দুটি হাত কিংবা মাথা থাকলেই হবে না। কেউ আপনাকে কানা-কড়িও দেবে না। সে জন্য এর যথার্থ ব্যবহারটি চাই। একমাত্র কাজের মধ্য দিয়েই এর ব্যবহার সম্ভব। যতই বজ্র আঁটুনি দেন না কেনো, গেরো ফসকা হলে তাতেও কাজ হবে না।
মার্ক টোয়েনের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দেই। তিনি বলেছিলেন, এই যে আকাশে এতো বজ্রের গর্জন শুনতে পাই, তার কোনওটিই কাজের নয়, তবে বিদ্যুতের একটি ছোট্ট ঝলকানিও অনেক কাজের।
হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ফল মিলবে না। তাই যদি কারো কোনও ফল মেলে তবে মনে রাখতে হবে তার পেছনে কোনও না কোনওভাবে লুক্কায়িত আছে কঠোর শ্রম।
রালফ র্যানসমের ভাষায় ফসল কাটার আগে বীজতো বুনতেই হবে। আর আনন্দের ফসল কাটার জন্য চাই কষ্টের বীজ বপণ।
কাজ না করলে তার প্রভাব মনোজগতের ওপরই পড়ে সবচেয়ে বেশি। যারা কাজ করেন না তারা সরাসরি কিছু ভাবতেও পারেন না। আর ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা,’ সে লোকভাষ্য বিশ্বজোড়া।
হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, আলস্য আসলে মনটাকে মুড়িয়ে রাখে।
ফলে কঠোর শ্রমের কোনও বিকল্প হতে পারে না। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করে বিশ্বে চির স্মরণীয় হয়ে থাকা টমাস আলভা এডিসন সে কথাই বলে গেছেন।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলতেন, ইশ্বর আমাদের যা কিছু দেন তা আসলে কঠোর যে শ্রম দেই তারই বিনিময়ে।
মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)’র শিক্ষা ‘মেহনত করো সবে’।
শ্রম সেতো প্রয়োজনই। কিন্তু কঠোর শ্রমের জন্যই আবার প্রয়োজন বিশ্রাম। আর বিনোদন। সেটাই মে দিবসের মূল শিক্ষা।
মানুষ শ্রম দেবে তার নিজের প্রয়োজনে। কিন্তু তার জন্য তাকে দিতে হবে ন্যয্য মজুরি, যথার্থ বিশ্রাম ও বিনোদনের সুযোগ। মে দিবস এমন একটি দিন যেদিন দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও আট ঘণ্টা বিনোদনের দাবি সামনে এনে চলে বিক্ষোভ। তাতে শহীদ হন আন্দোলনকারীরা। ফাঁসিতে ঝুলতে হয় সে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের।
ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে সেদিনই শহীদ হন ১১ জন। আর সেই বিক্ষোভের কারণে প্রহসনের বিচার চালিয়ে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশ্যে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছয় জনকে।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেটে যে দাবি ও তার পরিপ্রেক্ষিতে এত প্রাণদান তারও অনেক আগে, এমনকি খ্রীষ্টের জন্মেরও সাড়ে তিন শ’ বছর আগে দার্শনিক এরিস্টোটল বলে গেছেন, ‘শ্রমের শেষেই প্রয়োজন বিশ্রাম’।
আর শ্রমের জন্য চাই ন্যয্য মজুরি। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)’র বাণী- ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করো। ’
এসবই হোক আমাদের মে দিবসের শিক্ষা মে দিবসের প্রেরণা। মে দিবস হয়ে থাক চির মহান।
বাংলাদেশ সময় ২২০১ ঘণ্টা, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭
এমএমকে