ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

অধ্যাপনায় অবসর নিয়ে পত্রিকার হকারি!

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৭ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৭
অধ্যাপনায় অবসর নিয়ে পত্রিকার হকারি! অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইসহাক শরীফ পত্রিকা বিক্রি করছেন-ছবি: বাংলানিউজ

বরিশাল: ‘ভালো কাজ কাজই, সেটা ছোট হোক আর বড় হোক। সে কাজে যদি আনন্দ খুঁজেই পাওয়া যায়, তবে তাতে বাধা কিসের?’

বলছিলেন বরিশালের বাবুগঞ্জের আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইসহাক শরীফ। অবসরের পর থেকেই তিনি পিছিয়ে থাকা জনপদ বা দুর্গম অঞ্চলের মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে আর পাঠাভ্যাস তৈরিতে পত্রিকা হাতে ছুটে চলেন মাইলের পর মাইল।

কখনো বা যানবাহনে চড়ে, কখনো বা পায়ে হেঁটে গ্রাম থেকে গ্রামে, ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়নে।

৩৫ বছরের শিক্ষকতা শেষে গত বছরের ০১ মে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন ইসহাক শরীফ। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে হকারি করে তিনি এক বছর পার করলেন সোমবার (০১ মে)। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইসহাক শরীফ বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলছেন-ছবি: বাংলানিউজবিত্তশালী ও কলেজের অধ্যাপক হয়ে এ কাজ করায় বিভিন্ন কটূক্তি করেছেন স্বজনেরা। তবে এতে তিনি থেমে থাকেননি।

বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নের ইসহাক শরীফের বড় ভাই হাসান আলী শরীফ বাবা আবুল কালামের নামে ১৯৬৯ সালে রাকুদিয়ায় কলেজ স্থাপন করেন। তার পাশেই মায়ের নামে রয়েছে জামেনা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ইসহাক শরীফ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স শেষে বাবুগঞ্জে বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।

তারা চার ভাই দুই-বোনের সবাই শিক্ষিত। নিজের সন্তানদের মধ্যে মেয়ে বিএম কলেজ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষে বিয়ে করেছেন সরকারি চাকরিজীবীকে, ছেলে আছেন প্রাইভেট ফার্মে। স্ত্রী হাফিজা বেগমও আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজে লাইব্রেরিয়ানের চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন।

ইসহাক শরীফ প্রতিদিন সকাল ৬টায় নাস্তা খেয়ে রহমতপুরের উদ্দেশ্যে বের হন। সেখান থেকে পত্রিকা নিয়ে বাবুগঞ্জের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল হয়ে উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়ায় যান। সেখানে পত্রিকা বিক্রি শেষে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে যান বাড়িতে।

নিজে বাইসাইকেল চালাতে পারেন না। তবে ছাত্ররা অনেক সময়ই তাকে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন গন্তব্যে দিয়ে আসেন। এটাও তার কাছে সম্মানের।

ইসহাক শরীফ বাংলানিউজকে বলেন, ‘পাঠাভ্যাস উন্নয়নে পত্রিকার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে পাঠের প্রতি মনোযোগী হওয়া যায়। পত্রিকায় নতুন নতুন খবর প্রতিনিয়ত থাকছেই। জ্ঞান শুধু বইয়ের মধ্যেই থাকে না। জ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। আর জ্ঞানভাণ্ডার বাড়াতে তথ্যের প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্যই পশ্চাৎপদ এলাকায় এই পত্রিকা পৌঁছে দেওয়া’।

‘পাঠে মনোযোগী হলে নবীনরা বিভ্রান্ত হবে না, মাদক থেকে দূরে থাকবে। পত্রিকায়ও ভালো-মন্দ আছে। বিবেক ভালোকে গ্রহণ করবে আর মন্দকে পরিহার করবে’।

তিনি বলেন, ‘ঘাম ঝরানো পরিশ্রম সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন। আমি প্রতিদিন ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় তিনশ' পত্রিকা বিক্রি করি, যার মধ্যে ১৫ কিলোমিটারই পায়ে হেঁটে। এ কাজে কোনো সাইড ইফেক্ট নেই, ফাঁকিবাজি নেই, দুর্নীতির কোনো সম্ভাবনা নেই’।
ইসহাক শরীফ বলেন, ‘পরিবারের দায়িত্ব নেই যে, আয় করে দিতে হবে। সব মিলিয়ে এ কাজ করে ভালোই দিন কাটাচ্ছি। বাকিটা জীবনও এভাবেই কাটাতে চাই’।

প্রথম দিকে এলাকার লোকজন এটি গ্রহণ করেননি। এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেছেন। তবে এখন সেসব কেটে যাচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, ‘প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও এখন স্যার যে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর ব্রত নিয়ে পত্রিকা বিক্রি করছেন, সেটি সবাই বুঝতে পারছেন’।

ইসহাক শরীফের স্ত্রী হাফিজা বেগমও এখন মানিয়ে নিয়েছেন স্বামীর এ কর্মকাণ্ড। তিনি বলেন, ‘জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন। যদি কাজের মূল্যায়ন নাও পান, তাহলেও তার নিজের কাছেই শান্তি লাগবে যে, তিনি একটা কাজ করছেন’।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৭
এমএস/এএটি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।