পাশে যেতেই দেখতে পেলাম, প্রয়া ৫০ বছর বয়সী এক লোক। হাসিমাখা মুখে কাঁচা পাঁকা বড় বড় দাড়ি, মাথায় টুপি,পরণে ফুলহাতা টি-শার্ট আর ফুলপ্যান্ট।
হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে আমাকে বললেন, কিছু মনে করবেন না আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি? আমি হাসিমুখেই জবাব দিলাম আমার কোনো সমস্যা নেই। কি বলবেন বলতে পারেন।
এই বলে লোকটি তার দুই পায়ের জুতা খুলে প্যান্টের কাপড় হাটু পর্যন্ত উঠিয়ে দিলো।
হায় হায় এতোক্ষণ ধরে যে লোকটি এতো জোরে হাতুড়ি মারছিলো তার ডান পায়ের গোড়ালি কাটা। বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলও নেই। আমি কিছুটা অবাক হয়ে রইলাম।
তাকে দেখে বুঝার উপায় ছিলো না তিনি পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছেন।
নাম মোজাম্মেল হোসেন, গ্রামের বাড়ি বরিশালের জালকাঠি। পেটের তাগিদে ১৯৯০ সালে ঢাকা এসে বিভন্ন জায়গায় লেবারের কাজ করতেন। যা আয় করতেন তা থেকে বাড়িতে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে কষ্ট হতো। তাই ১৭ বছর পর ২০০৭ সালে তিনি রাজধানীর কদমতলী উজালা আয়রন মার্কেটে মাসিক বেতনে লোহা কাটার কাজ নেন। এইকাজ করে যা পান, তাতে তিন মেয়ে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিলো।
তবে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, প্রতিদিনের মতো সকালে কাজে এসেছিলেন মোজাম্মেল। ঘড়ির কাটা তখন পৌঁনে আটটা। ডিউটি শুরু আটটায়। মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন সহকর্মীর সঙ্গে। এমন সময় এক ট্রাক লোহার পাত আসে। মার্কেটের লেবাররা একত্রিত হয়ে পাতগুলো নামিয়ে মার্কেটের ভেতরে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হঠাৎ করে একটি বড় পাত লেবারদের কাঁধ থেকে ফসকে পড়ে যায় আমার পায়ের উপর। সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে আলাদা হয়ে যায় ডান গোড়ালী এবং বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল। চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। টানা ৮ মাস চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হন। ওই স্মৃতি আজও ভুলতে পারছেন না।
তিনি বলেন, আমার জীবনটা এমন ভাবে নষ্ট হবে কখনো চিন্তা করিনি। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমার মালিক বলেছিলেন সব খরচ বহন করবেন। চিকিৎসার খরচ বাবদ ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আর কিছুই করননি। কিন্তু আমার খরচ হয়েছে প্রায় লাখ টাকা। এটা হলো নিয়তি আর এ নিয়তি মেনে নিয়ে আজো আমি কাজ করে যাচ্ছি। কারো কাছে হাত পাতিনি। তিনি বলেন, আমার সহকর্মীরা কয়েকজন টাকা তুলে আমাকে একটা আলগা পা কিনে দিয়েছিলেন আর কিছু টাকা সাহায্য করেছিলেন। তাদের কথা আমি জীবনেও ভুলবো না।
এই পা নিয়ে আজ ২ বছর ধরে কাজ করছি। যদিও কোনো ভারি কাজ করতে পারছি না। তাই আগের মতো বেতন ও পাই না। সংসারে টানাপোড়েন।
কারন ভিক্ষা করে খাওয়ার চেয়ে নিজে রোজগার করে একবেলা খাওয়ার সুখই আলাদা। আমার স্ত্রী, মেয়ে, দুই মেয়ের জামাইরা তো বলতে পারবে আমার বাবা এখনো কাজ করে। এটাই আমার শান্তি। এটাই আমার তৃপ্তি। আমার তো এক পা নেই। দুনিয়াতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের দুই পা নেই তারা চলেন। আল্লাহ তো তাদের চেয়ে আমাকে ভালো রাখছেন। তিনি বলেন- এভাবেই জীবনের বাকি দিনগুলো সৎভাবে কাজ করে যেতে পারাটাই হলো আমার শেষ চাওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৭
বিএস