কিন্তু কবি নজরুলের স্মৃতিবাহী কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন পথে স্থাপিত ১২ টি ফলকের মধ্যে ৯টিরই করুণ দশা। এদের কয়েকটা কবে যে তুলে ফেলা দেয়া হয়েছে সে খবরও কেউ রাখেনি।
কুমিল্লার ৯ স্মৃতিফলক:
ধূমকেতুর মত উদ্ভাসিত কবি নজরুল ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাচঁবারে ১১ মাস কাটিয়েছিলেন কুমিল্লায়। নজরুলের প্রেম,বিয়ে-বিচ্ছেদ, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতিচর্চসহ বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে আছে কুমিল্লার বিভিন্ন জনপদে স্থাপিত স্মৃতিফলকগুলো।
১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর শহরের ঝাউতলা সড়কের শেষ প্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার জন্য কবি গ্রেফতার হয়েছিলেন। সেই স্থানে রয়েছে একটি স্মৃতিফলক। স্মৃতিফলকের পাশে গড়ে উঠেছে শীতক প্রকৌশলীর দোকান । সে দোকানের নষ্ট হওয়া ফ্রিজ ও এসির মেশিন, বালতিতে ঢেকে আছে নজরুলের সে স্মৃতিফলক।
কুমিল্লায় এসে প্রতিবারই তিনি উঠতেন কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। অর্থাৎ প্রমীলাদের বাড়িতে। প্রমীলাদের বাড়ির পুকুরটি কবেই ভরাট করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা। বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। সেই বাড়ির স্মৃতিফলকটিও এখন আর নেই।
১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর রাজগঞ্জ বাজারে নজরুল ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানকার স্মৃতিবিজড়িত ফলকটিও এখন আর নেই। এখন সেখানে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন ।
প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেসনেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির পরিচয় হয় বাগিচা গাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সাথে। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতিপাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন। এখানে নজরুল-ফলক ছিল।
এ স্মৃতিফলকটি ব্যবসায়ীরা সরিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে বসিয়ে দিয়েছেন।
শহরের বজ্রপুরে বহু পুরাতন কুমিল্লা ইউসুফ হাই স্কুলের নিকটেই ছিল অবিনাশ ময়রার দোকান। এই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। এখন সেটি আর নেই। স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো ফলকও নেই।
কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ ক’বার দারোগাবাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী এই বাড়ির সঙ্গীত-জলসায় অংশ নিয়েছেন। নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে। ফলকে উল্লেখ করা হয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিসে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেক গান গেয়েছেন। আগামীকাল নজরুলের জন্মবার্ষিকী উৎসব। অথচ নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানের কোনো খবর কেউ নিচ্ছে না।
শহরের দ্বিতীয় মুরাদপুর মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মন বাহাদুরের রাজবাড়িতে ১৯২২ সালে নজরুল অনেকদিন কুমার শচীন্দ্র দেব বর্মনের সঙ্গে বসে সঙ্গীতচর্চা করেছেন। সাবেক জেলা প্রশাসক মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শচীন দেবের এই বাড়িটি সংস্কারসহ সাংস্কৃতিককেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়।
নানুয়ার দিঘিরপাড়ের সুলতান মাহমুদ মজুমদারের বাড়ি, নবাববাড়িতে নজরুলের স্মৃতিফলকগুলোও অযত্নে,অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
মুরাদনগরেও নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন
বিয়ের রাতেই নজরুল অজ্ঞাত কারণে দৌলতপুর ছেড়ে চলে গেলেও রেখে গেছেন অনেক স্মৃতিচিহ্ন। সেই সব স্মৃতিময় গাছ, ঘাট, বাসরঘর, খাট প্রভৃতির সৌন্দর্য মলিন হতে বসেছে। বাসর ঘরের খাটে এখন মানুষ ঘুমায়,সেই বালিশ,কাঁথা ব্যবহার হচ্ছে। বাসর ঘরটিও আগের অবস্থায় নেই,পুরোটা প্রায় ভঙ্গুর। যে আম গাছের নিচে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন সেটি মরে গেছে। আলী আকবর খাঁ মেমোরিয়াল ভবনটিও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। এটির সংস্কার ও সংরক্ষণ অতি জরুরি।
এদিকে মুরাদনগরের দৌলতপুরের প্রবেশপথে নজরুল তোরণের দু’পাশে স্থাপিত নজরুলের কবিতা-গান সম্বলিত ৫/৬ টি ফলক ভেঙে গিয়ে ঝুলে আছে।
কুমিল্লা নজরুল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অশোক বড়ুয়া বলেন, ২ বছর আগে এসব ফলকের সংস্কার করার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছিলাম। মাত্র তিনটি স্মৃতিফলক সংস্কার করা হয়েছে। বাকিগুলো অবহেলিত। নজরুলের এই স্মৃতিফলকগুলোর অচিরেই সংস্কার করা উচিত। এসব স্মৃতিফলক বিলীন হয়ে গেলে কুমিল্লার মানুষ এক সময় ভুলেই যাবেই নজরুলের পদচারণা ছিল এ জনপদে।
বাংলাদেশ সময়:১১৪৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
জেএম