ছোটবেলায় স্কুলে প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে এমন শপথ আমরা সবাই করেছি। কিন্তু বড় হলে বা কলেজ পর্যায়ে প্রতিদিন এই শপথ পাঠ করে দিন শুরু করা বিরল ঘটনা।
তবে হ্যাঁ এখানে প্রতিদিন ৪র্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী এবং সব শিক্ষকদের সকাল সোয়া ৮টার মধ্যে মাঠে হাজির হতে হয়। সাড়ে ৮টায় শুরু হয় অ্যাসেম্বলি। প্রথমে ধর্মীয় অনুশাসন পালন, এরপর শুরু হয় শরীর চর্চা। শরীর চর্চা শেষে জাতীয় সংগীত ও শপথ পাঠ। এটা তাদের প্রতিদিনের রুটিন।
কথাগুলো বলছিলেন যশোরের আকিজ উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ। আকিজ কলেজিয়েট স্কুল সম্পর্কে তিনি বলেন, বাচ্চাদের প্রতিদিন শপথ পাঠ করানোর উদ্দেশ্য হলো দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করা, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শেখানো। সে যে ক্লাসের ছাত্র/ছাত্রীই হোক, প্রতিদিন তাকে অ্যাসেম্বলিতে আসতে হয়। সেখানে দেশ রক্ষার শপথ নিয়েই তাদের দিনের শুরু হয়।
সরকারের কোনো অনুদান ছাড়া, আর শহরের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের বাইরে থেকেও এমন সুশৃঙ্খল শিক্ষার পরিবেশ আমাদের দেশে বিরল ঘটনা।
বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার দিকে বাংলানিউজের একটি টিম নাভারণ থেকে যশোর জেলা শহরে যাওয়ার পথে অনেকটা কৌতুহল নিয়ে এই কলেজে প্রবেশ করে। জেলা শহর থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামের কলেজে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দ্বিতল বাস ঢুকতে দে মঙ্গলবার দেখেই মূলত এই কৌতুহলের সৃষ্টি।
তবে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় আরো চাঞ্চল্যকর কিছু দৃশ্য। সীমানা প্রাচীর না থাকায় বাইরে থেকে দেখে বোঝারই উপায় নেই এই কলেজের ভেতরে তিন তিনটি বিজ্ঞানাগার (পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীব বিজ্ঞান ল্যাব) রয়েছে। রয়েছে ২৫টি কম্পিউটারসহ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত কম্পিউটার ল্যাব, এছাড়া বঙ্গবন্ধুর জীবনী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ বিভিন্ন ধরনের ৪হাজার ৬শ বইয়ের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন কলেজ এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি দ্বিতল বাস সহ মোট তিনটি বাস তিন রুটে যাতায়াত করে।
এখানে সপ্তাহে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দুই দিন ৫০ মিনিট করে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হয়। মাসে একটা করে ইনকোর্স পরীক্ষা দিতে হয়। প্রতিদিন কম্পিউটার শেখা এবং খেলাধুলার জন্যও এখানে নির্দিষ্ট একটা সময় বরাদ্দ থাকে।
এছাড়া এখানে পড়লে বাইরে আর প্রাইভেট পড়তে হয়না বলেও জানান ৯ম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ইভা এবং অন্তরা।
এদিকে শহর থেকে এতো দূরে আর মফস্বলে অবস্থিত হলেও প্রতিবছর সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পাচ্ছে যশোরের শেখ আকিজ উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুল।
অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ গত কয়েক বছরের এসএসসি এবং এইচএসসি’র ফলাফলের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন সারাদেশের মধ্যে এটিই শহরের বাইরে একমাত্র সেরা প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, অনেক এতিম হতদরিদ্র ছেলে মেয়েও এখান থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে এবং উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে। অনেকে পড়ালেখা শেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বড় বড় পদে চাকরি করছে।
আলোকিত মানুষ ও আলোকিত সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ১৯৯১ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার নাভারণে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজ উদ্দিন।
এরপর থেকেই কোনো প্রকার সরকারি অনুদান ছাড়াই অবকাঠামো নির্মাণসহ স্কুলটি পরিচালনা করে আসছে আকিজ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৫ সালে প্রথমবার এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাস সহ ভালো ফলাফল করে শিক্ষার্থীরা। ধাপে ধাপে এই প্রতিষ্ঠানের সফলতা বেড়েই চলেছে বলেও জানান অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ।
তিনি বলেন, এসএসসি- তে ২০০৪ সালে বোর্ডে ৫ম, ২০০৫ সালে ৪র্থ, ২০০৬ এবং ০৭ সালে ৩য় সহ মোট ১১ বার বোর্ডে সেরাদের তালিকায় স্থান পায় এই প্রতিষ্ঠান। তবে বর্তমানে বোর্ড থেকে স্থান নির্বাচন করা না হলেও সর্বশেষ ২০১৭ সালে ১৫৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৭১ জন এ-প্লাস পায়।
একই ভাবে এইচএসসি. ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সেরা তালিকায় স্থান পাচ্ছে আকিজ কলেজিয়েট স্কুল।
এখানে বাংলা মাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে ২০০৩ সাল থেকে ইংরেজি মাধ্যমেও পড়া লেখা করানো হয়। এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তাদের প্রতিদিন সহীহ্ কুরআন ও হাদিস শিক্ষা দেয়া হয়। সব থেকে অবাক করা বিষয় হলো এখানে শিক্ষার্থীদের মাত্র ১হাজার টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
কলেজ অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ বলেন, ব্যতিক্রমধর্মী পাঠদান পদ্ধতি, ক্লাসের পড়া ক্লাসে আদায় করা, আনন্দের সঙ্গে পাঠদান, ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক ও প্রশাসনে কঠোর নজরদারি এবং সবার সার্বিক সহযোগিতার ফলে প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যায়ে এসেছে।
তিনি বলেন, আকিজ কলেজিয়েট স্কুলের অন্যতম উদ্যোক্তা ও পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ডা. শেখ মহিউদ্দিন চেয়েছেন তার বাবার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে এ অঞ্চলের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শহরের পরিবেশে আধুনিক ও পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে। এজন্যই তার এই প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৭
এসআইজে/এসএইচ