সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর জেলা ও দায়রা জজ বরাবর ছদ্মনাম ব্যবহার করে তিন ছাত্রী ওই শিক্ষকের অপকর্ম তুলে ধরে তার শান্তির দাবিতে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এই শিক্ষকমহলসহ স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন রনি জেলা শহরের নারিকেল বাগান এলাকায় একটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়ে ‘এমইএফ’ নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। সর্বশেষ বাসার মালিক রনির শ্লীলতাহানির অভিযোগ, আচরণ ও চলাফেরা সন্দেহ হওয়ায় তাকে বের করে দেন। পরে তিনি আনন্দনগর এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং সেন্টার চালান। সখোনে যাওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ ওঠায় বর্তমানে শিক্ষক রনি পলাতক রয়েছেন।
এদিকে পুলিশ বলছে এর আগেও ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মৌখিকভাবে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নারিকেল বাগান এলাকার রাজু বোডিং এর পেছনে একটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং সেন্টার চালিয়ে আসছিলেন দেলোয়ার হোসেন রনি। কোচিং সেন্টারটির নাম ‘এমইএফ কোচিং সেন্টার’।
খাগড়াছড়ির একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী পূজা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘রনি স্যারের কাছে দীর্ঘ আড়াই মাস পড়েছি। ভালো পড়াতেন বলে অনেক শিক্ষার্থী উনার কাছে পড়তে যেতেন। আমি ৩টা ১০ মিনিটের ব্যাচে পড়তাম। একদিন প্রাইভেট শেষ করে ফেরার পথে স্যার ফোন দিয়ে আবার কোচিং সেন্টারে যেতে বলেন। সেখানে গেলে স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরেন আর কুরুচিপূর্ণ কথা বলেন। এ সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চিৎকার দিতে গেলে আমাকে ছেড়ে দেন। ’
একই কলেজের অপর শিক্ষার্থী দিনা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘স্যারের কাছে আমি ১০দিন পড়েছি। শুরুর দিকে ভালো আচরণ করলেও কয়েকদিন পর আমার প্রতি স্যারের অদ্ভুত আচরণ লক্ষ করি। তিনি একদিন আমাকে ৩টা ১০ এর ব্যাচ ২টা থেকে পড়ানো হবে জানান। গিয়ে দেখি সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এসময় তিনি গা ঘেঁষে বসে শরীর স্পর্শ করতে শুরু করেন। বাধা দিতে গেলে কুরুচিপূর্ণ কথা বলেন। এমন সময় এক বান্ধবী আসায় তিনি আমাকে ছেড়ে দেন। এরপর থেকে রনির কাছে ওই শিক্ষার্থী আর পড়তে যায়নি। এদিকে একই রকম ঘটনা পরিচিত আরো ৪/৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘটেছে। ’
এদিকে নারিকেল বাগান এলাকায় ওই শিক্ষকের আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন বাড়ির মালিক নুরুল ইসলাম সওদাগর। এই বিষয়ে নুরুল ইসলামের মেয়ে রুমানা আক্তার জানান, আমার পরিচিত এক মেয়েকে কৌশলে তার কাছে পড়তে বাধ্য করে। ৩ দিনের মাথায় মেয়েটিকে নানা উপহার সামগ্রী দিয়ে অনৈতিক কাজ করতে চাইলে সে বাধা দেয়।
‘এরপর লজ্জায় তার মা-বাবাকে না বললেও আমাকে বিষয়গুলো খুলে বলেছে। এছাড়া ওই শিক্ষকের আচরণ ছিল সন্দেহজনক। কারো সঙ্গে মিশতো না। ঘর থেকে বের হতো না। বের হলেও গভীর রাতে বের হতো। তাই রনিকে আমাদের বাড়ি বের করে দেওয়া হয়। ’
একই বিল্ডিংয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভাড়াটিয়া জানান, অন্যদের দিয়ে ঘরের বাইরে তালা ঝুলিয়ে ২/৩ দিন ওই শিক্ষক ঘরের ভেতরে থাকতেন। রাত হলেই ঘর থেকে বের হতেন তিনি।
জানা যায়, রনি কুষ্টিয়ার বাসিন্দা হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। তবে নিজেকে কখনও চট্টগ্রাম, কখনও কুমিল্লার বাসিন্দা বলে দাবি করেন। নারিকেল বাগান এলাকায় বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় ভোটার আইডি কার্ড চাইলে নিজে এখনও ভোটার হননি বলেও বাড়িওয়ালাকে জানান রনি।
তবে আনন্দনগর এলাকার বাড়ির মালিক শিক্ষকের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নিয়ে বাসা ভাড়া দেন। তবে ওই বাসার মালিক অভিযুক্ত রনির অনুমতি ছাড়া এই প্রতিবেদককে কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এদিকে গত ১৯ অক্টোবর এক ছাত্রী সদর থানায় মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন। সর্বশেষ জেলা ও দায়রা জজের কাছে দেওয়া অভিযোগে সুপ্রিয়া রাণী দাশ, নন্দিনী চৌধুরী ও মনি ত্রিপুরা নামে তিন ছাত্রী ছদ্মনাম ব্যবহার করে শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন।
পাশাপাশি ওই শিক্ষকের আচার-আচরণের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কোচিং সেন্টারে অভিযান, তার ব্যবহৃত মোবাইল জব্দ করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান তারা।
খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. সুধীন কুমার চাকমা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, এটি খুবই নিন্দনীয়। অভিযুক্ত শিক্ষক অন্য শিক্ষকদের মান সম্মান ক্ষুণ্ন করছে। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারেক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই শিক্ষকের অপকর্মের বিষয়টি আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। আমরা ওই শিক্ষক সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো।
এদিকে একাধিকবার কোচিং সেন্টারে গিয়েও দেলোয়ার হোসেন রনিকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৭
বিএস