ঢাকা: জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলা ৭০ বছর অতিক্রম করেছে। ১১ অক্টোবর বহুভাষি এই সংবাদ মাধ্যমটি ৭০ বছরে পদার্পণ ঘটে।
সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানই এখন বিবিসি বাংলা’র সম্প্রচারের মূল উপজীব্য। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বিবিসি বাংলা।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল চালুর আগে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানতে রেডিওতে প্রচারিত বিবিসি বাংলার খবরে নির্ভরতা ছিল অনেক বেশি। সাদ্দাম-ইরাক-কুয়েত ইস্যুতে এক সময় গ্রাম-গঞ্জের মানুষ জড়ো হয়ে বিবিসি বাংলার খবর শুনতো। এখনও জনপ্রিয়তা কম নয়। আর এফএম ব্যান্ডে মোবাইল ফোনের সুবাদে সহজেই এখন শোনা যায় বিবিসি’র খবর।
আন্তর্জাতিক ঘটনার পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে বিবিসি’র খবর এদেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশষত ২০০৭ সালে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতার সময়ে অনেকের মতে মিডিয়ার উপর ‘অদৃশ্য হাতের চাপ’ থাকাকালেও বিবিসি বাংলা তথ্য প্রচারে একমাত্র বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।
৭০ বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠানের বিবর্তন নিয়ে মাধ্যমটির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূলত সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। ’
‘নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেণ বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় এক কোটি শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বিবিসি বাংলা। ’
কীভাবে সংবাদ বিবিসি বাংলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠল:
ওই প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ি, ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর যাত্রা শুরুর সময় প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত হতো একটি মাত্র অনুষ্ঠান, যা ছিল মূলত একটি ‘নিউজলেটার’। অনুবাদ করে তা পড়তেন বিভিন্ন জন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে ভারত থেকে অনুষ্ঠান প্রযোজনার জন্য আসেন কমল বোস এবং রেখা আলী।
তাদের পরিবেশনায় ভারতীয় বাংলাভাষী শ্রোতাদের জন্য শুরু হল ‘বিচিত্রা’ নামের একটি ম্যাগাজিন।
এরপর ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষি শ্রোতাদের জন্যও তৈরি হল ‘আঞ্জুমান’ নামে আলাদা একটি অনুষ্ঠান। সেটিও ছিল বিচিত্রা’র ঢঙে। সংবাদ সেখানে গুরুত্ব¡ পেত না। অনুষ্ঠানটি প্রযোজনার জন্য নিয়ে আসা হল নাজির আহমেদকে।
১৯৬৫ সালে বিবিসি বাংলা’র সম্প্রচারে প্রথম যুক্ত হল সংবাদ। ওই বছরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলা অনুষ্ঠানের শ্রোতারা দাবি করলেন হিন্দি আর উর্দুর মত বাংলাতেও প্রতিদিন বিবিসি থেকে তারা যুদ্ধের নির্ভরযোগ্য আর নিরপেক্ষ খবর চান। তাদের যুক্তি ছিল, জাতীয় বেতারে তারা শুধু কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত খবরই পাচ্ছেন। এই দাবির মুখেই শুরু হল সংবাদ পরিবেশন।
১৯৬৯ সালে বিবিসি তার দেশভিত্তিক সম্প্রচার নীতি পাল্টিয়ে চালু করল ভাষাভিত্তিক সম্প্রচার নীতি। শুরু হল সম্মিলিত সম্প্রচার। আর ঠিক হল অনুষ্ঠানের পরিকল্পিত একটা কাঠামো।
প্রতিবেদনটিতে বিবিসি বাংলা’র সাবেক প্রধান সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ‘সে সময় বাংলা বিভাগে যেসব গুণীজন কাজ করতেন, তাদের সাংবাদিকতার কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং একদল নতুন সাংবাদিক দলে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে সম্পূর্ণ হয় এই বিবর্তন। ’
এদিকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা বিভাগের সম্প্রচারে ছিল কিছু সংবাদ আর নানা ধরনের বিনোদন অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ। বাংলা বিভাগের জন্য সংবাদ সংগ্রহের কোনও নেটওয়ার্ক সে সময় তৈরি হয়নি। আন্তর্জাতিক খবরগুলো মূলত অনুবাদ করে সম্প্রচারিত হতো। ঢাকা থেকে বিবিসি বাংলা’র জন্য খবর দিতেন আতাউস সামাদ।
নব্বইয়ের দশকে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের তৎকালীন পরিচালক জন টুসা নির্দেশ দিলেন সব ভাষা বিভাগকে তাদের নিজস্ব সাংবাদিকতায় আরও প্রসারিত করতে। বিশ্ব রাজনীতির পটভূমিতে সংবাদকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। সৈয়দ মাহমুদ আলী তখন ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রধান।
নানা আঙ্গিকের অনুষ্ঠানমালার মধ্যেই ২০০৫ সাল থেকে বিবিসি বাংলা’র বেতার ও টিভি অনুষ্ঠান ‘বাংলাদেশ সংলাপ’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সাবির মুস্তাফা বিবিসি বাংলা’র প্রধান হলেন ২০০১ সালে। তখন থেকে বাংলা অনুষ্ঠানের চেহারা অনেক বদলেছে। বেতারের পাশাপাশি টিভিতে বাংলাদেশ সংলাপ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে সাংবাদিকতার একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বিবিসি বাংলা’র জন্য।
বিশেষ প্রতিবেদনে সাবির মুস্তাফা বলেন, ‘বেতার অনুষ্ঠানে এখন শ্রোতাদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। তারা ‘ফোন ইন’ অনুষ্ঠানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে তাদের মতামত রাখতে পারছেন। ’
তিনি বলেন, ‘বেতার ও টিভি ছাড়াও এখন বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে প্রতি ঘণ্টা খবর আপডেট করা হয়, যা শোনা যায় বাংলাদেশের যে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে ১৬২৬২ ডায়াল করে। ’
এছাড়াও www.bbcbangla.com শীর্ষক ওয়েব সাইটে যে কোনও সময়ে শোনা যাচ্ছে বিবিসি বাংলার খবর ও ফিচার।
সাবির মুস্তাফা বলেন, ‘যতদিন বাংলাদেশে বিবিসি বাংলা’র সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেণের চাহিদা থাকবে ততদিন যে কোনভাবে শ্রোতাদের কাছে সে সব খবর তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে যাবে বিবিসি বাংলা। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১