পুরুষ শ্রমিকরা ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে ধুমপান করছেন। কিন্তু নারী শ্রমিকরা কাজ করেই চলেছেন।
কাছে গিয়ে নারী দিবস (০৮ মার্চ) সম্পর্কে কথার সূত্রপাত করার চেষ্টা। কিন্তু তার আগেই মনের মধ্যে জমাট বাঁধা ক্ষোভ আর কষ্টের বিস্ফোরণ ঘটালেন নারী শ্রমিক সুফিয়া।
বললেন, ‘ওইসব দিবস-টিবস বুঝি না। পুরুষের সমান সমান কাজ করি, কিন্তু মজুরি পাই অর্ধেক! কোথায় বলবো, কে করবে এই বিচার? আর দিবস জেনে কি করবো?’
সুফিয়ার প্রশ্নবানে জর্জরিত হলেও সাহস করে জানা গেলো তাদের জমানো কষ্টের কথা। নারী দিবস আসে আর যায়, কিন্তু সুফিয়ার মতো নারী শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। কর্মঘণ্টা বলতে তাদের কাছে কিছু নেই। যতক্ষণ কাজ চলে ততক্ষণই করতে হয়। তবে পুরুষের সমান কাজ করেও দিন শেষে তাদের কপালে জোটে অর্ধেক মজুরি।
নারী-পুরুষ বৈষম্যের কারণে এখনও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য মজুরি থেকেই। তাই নারী দিবসের কোনো আনুষ্ঠানিকতা তাদের মনকে আর স্পর্শ করতে পারে না।
ইট ভাঙা শ্রমিক সুফিয়া বাংলানিউজকে বলেন, তার বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার কালামৃধা গ্রামে। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর ১০ বছর আগে এক স্বজনের মাধ্যমে কাজের সন্ধানে রাজশাহী আসেন। কোনো কাজ না পেয়ে পেটের দায়ে ইট ভাঙার কাজ করেন। রোজ কাকডাকা ভোরে শ্রমের বাজারে গিয়ে বসেন। দিনমজুর হিসেবে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গেই শ্রম বিক্রি করেন। নারীরা কাজে ফাঁকি কম দেন বলে প্রায় প্রতিদিনই কাজ মেলে। কিন্তু ন্যায্য মজুরি মেলেনা দুঃখ করে বলেন সুফিয়া। জানতে চাইলে সুফিয়া বলেন, তিনিসহ অন্য নারীরা প্রতিদিন পুরুষদের সমান ইটা ভেঙে তা মেশানো ও ঢালার কাজের জন্য দিন চুক্তিতে মজুরি পান ২৫০ টাকা। আর পুরুষ শ্রমিকরা পান ৫০০ টাকা। অথচ তারা পুরুষদের সমান কাজ করেন। কিন্তু কেবলমাত্র নারী শ্রমিক বলে সবাই তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে। ইট ভাঙা, বালু মেশানো, বহন ও রাস্তায় ঢালার কাজ শুরু করেন সকালে। শেষ করেন সন্ধ্যার একটু আগে।
তার সঙ্গে কাজ করা অপর নারী শ্রমিক জমেলা বাংলানিউজকে বলেন, পুরুষ শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেয়। চা পান করতে যায়, ধুমপান করে। কিন্তু তারা বিশ্রাম করার সুযোগ পান না। কেবল দুপুরে খাবারের জন্য আধাঘণ্টা ছুটি পান। তারপরও খেতে বসলে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে বার বার তাগাদা দেন। যত বৈষম্য, সব তাদের ক্ষেত্রেই।
আগে প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু লাভ না হওয়ায় এখন আর প্রতিবাদও করেন না। ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়। তাই নারী দিবস কী এবং কেন তা কোনোদিনই জানার চেষ্টা করেন না।
এটি ছিলো রাজশাহী জেলা প্রাথমিক কার্যালয়ের সামনের সড়কে কাজ করা নারী শ্রমিকদের একটি খণ্ডচিত্র। কিন্তু মহানগরী ঘুরে এমন আরও অসংখ্য খণ্ডচিত্র দেখা গেছে।
শ্রমিকরা এখন ঘর-গৃহস্থলির কাজের গণ্ডি পেরিয়ে হাতে হাঁতুড়ি, কোদাল-কাস্তে, মাথায় ঝুঁড়ি নিয়ে অভাব অনটন ক্ষুধা আর দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে চলেছেন। ইট-পাথর ভাঙা, মাটি কাটা, সিমেন্ট বালু মিশ্রণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও চা-মিষ্টির দোকানে পানি টানার মতো কঠিন পরিশ্রম করছেন নারী শ্রমিকরা।
কিন্তু ন্যায্য শ্রমঘণ্টা বা মজুরি কোনোটিই পাচ্ছেন না তারা। দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। নারী দিবস এলে সবাই তাদের কথা বলেন। পরে আবার ভুলে যান। কিন্তু তাদের এই বৈষম্য দূর হয়না।
রাজশাহীর মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট-এসিডির প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এহসানুল আমিন ইমন বাংলানিউজকে বলেন, কেবল মাঠে-ঘাটেই নয়। সংসদেও নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হন। অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বও সমান। কিন্তু তারা সম অধিকার পাচ্ছেন না। এসব ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে সরাসরি রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে নারীর মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার অর্জন তিমিরেই থেকে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০১৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮
এসএস/জেডএস