খুলনা মহানগরীর গোবরচাকার এ সংগ্রামী তরুণীর নাম সুমনা সিরাজ সুমী। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তার সংগ্রামী জীবনের গল্প তুলে ধরেন বাংলানিউজের কাছে।
১৯৯৪ সালের ৫ মে খুলনায় তার জন্ম। বাবা মো. গোলাম মোস্তফা কবির। মা রাশিদা বেগম। চার বোনের মধ্যে তিনি বড়। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। আদর্শ শিশু বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার হাতে খড়ি। মাত্র ৬ বছরে ২০০০ সালের ২৬ মে ছোটনদী খেলাঘর আসর আয়োজিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জয়ন্তীতে কবিতা প্রতিযোগিতায় শিশু বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেই থেকে কবিতা প্রেম এবং রবীন্দ্রনাথ ভক্তি। যদিও রক্ষণশীল পরিবারে কবিতা চর্চা দুঃসাধ্য ছিল। ফুফাতো বোন শাহানা হকের সাহায্যে চলে খেলাঘরে যাতায়াত। খেলাঘর আসরের নানা শ্লোগান আর কবিতা প্রেম মায়ের হাতে মার খাওয়ার কারণ হয়েছে অনেক। পড়ার বইয়ের থেকে গল্পের বইয়ে বরাবর ঝোঁক ছিল বেশি। এর মধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শুদ্ধ বাংলা পড়া, কবিতা আবৃতি, উপস্থিত বক্তৃতায় বেশ পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে যুক্ত হন থিয়েটার খুলনার সঙ্গে। সুন্দরবনের মানুষ নামের নাটক দিয়ে থিয়েটার যাত্রা। এই পথের যাত্রা নিয়ে সুমী বলছিলেন, ‘পরিবার এগুলো মেনে নেয় না। এদিকে ফুফাতো বোন তখন খুলনার বাইরে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। দাদীর ছায়া পেলেও বাবা মায়ের সম্মতি ছিল না মোটেও। পারিপার্শ্বিকতাও ছিলো বৈরী। ছোটবেলা থেকে কাজের অদম্য আগ্রহ এবং কৌতুহল থাকায় সংস্কৃতি থেকে দূরে যাওয়া হয়নি। বাসা থেকে লুকিয়ে চলে সব। প্রকাশ পেলেই মার। এর মধ্যে ভর্তি হই এস ও এস হারম্যান মেইনার স্কুলে। কিছুদিন যেতে না যেতেই হারম্যান মেইনার স্কুলে সপ্তাহে ৬টি ইভেন্টে বিজয়ী হই। ’
সুমী জানান, ২০০৮ সালে পারিপার্শ্বিক কারণে অষ্টম শ্রেণিতে বাল্যবিবাহের শিকার হন তিনি। স্বামীর নাম সিরাজুর রহমান সিরাজ (জসীম)। ইচ্ছে থাকলেও পড়ার উপায় ছিলো না। স্কুলে ভর্তি হয়েও পড়া আর হলো না। শুরু হয় বন্দি জীবন। সঙ্গী গল্পের বই, তাও চুরি করে পড়তে হতো। শাশুড়ীর মতে বই পড়লে ঘরের বউ খারাপ হয়ে যাবে। মা হন ২০১০ সালে। সন্তান জন্মের আড়াই মাস পরেই হার্টের ভাল্ব নষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন স্বামী। আড়াই মাসের শিশু সন্তান নিয়ে হয়ে যান দিশেহারা। তবে, বসে থাকেননি। হাতের সেলাই কাজের পাশাপাশি বয়স্ক স্কুলেও কাজ শুরু করেন। ভর্তি হন হোপ টেকনিক্যাল স্কুলে দর্জি এবং ব্লক-বাটিক কোর্সে।
কখনও শ্বশুর বাড়ি, কখনও বাবার বাড়ি, এভাবে চলে অনিশ্চিত জীবন। সন্তানের খরচ যোগানের পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন। বেতারে গোষ্ঠী নাটকের মাধ্যমে এই অঙ্গনে কাজ শুরু করেন। নাট্যনিকেতনে থিয়েটার শুরু হয়। আহছান উল্লাহ কলেজে এইচএসসি করে এখন সরকারি বি এল কলেজে দর্শন বিভাগে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। আক্ষেপ করে সুমী বলেন, বাবা ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের আর্থিক অবস্থা অনেকটা স্বচ্ছল থাকলেও স্বামী মারা যাওয়ার পর কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। আর্থিক সাহায্য তো করেইনি, বরং আমার কাজ থেকেই আমাকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। যদিও এখন আমার সফলতায় সবাই গর্ব করে।
সুমী বলেন, বেতারে উপস্থাপক হিসেবে যোগ দিই ২০১৩ সালে, নাটকে ২০১১ সালে এবং সংবাদ পাঠক হিসেবে ২০১৭ সালে। বর্তমানে বেশি কাজ করি বেতার এবং স্টেজ উপস্থাপক হিসেবে। শিল্পকলার সদস্য আমি। লেখক ফোরাম, সাহিত্য একাডেমি কমিটিরও সদস্য। সরকারি বি এল কলেজ আবৃত্তি সংগঠন বায়ান্ন (৫২) এর সহ–সভাপতি। আমার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই আয়ের উৎস।
কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন বহু। ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বরে জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা আয়োজিত জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কবিতা আবৃত্তিতে ঘ বিভাগে পান জাতীয় পুরস্কার। হন প্রথম রানার্স আপ। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৮-তে কবিতায় খুলনা জেলায় প্রথম হন।
আগামী দিনে কী স্বপ্ন দেখছেন? এমন প্রশ্নে এ সাংস্কৃতিক কর্মী বলেন, বর্তমানে কবিতা শেখাচ্ছি ছোট্ট সোনামনিদের। এছাড়াও কাজ করছি বাংলা প্রমিত উচ্চারণের ওপর। স্বপ্ন দেখছি নারীদের সামাজিক অর্থনৈতিক মুক্তির। প্রিয় কবিতার তালিকায় নারীদের মুক্তি সম্পর্কিত কবিতা প্রথম পছন্দ আমার। ব্যাঞ্জন নামের একটি ইভেন্ট ফার্ম নিয়ে কাজ করছি এবং কাজ তৈরির সুযোগ করে দিচ্ছি তরুণ-তরুণীদের।
এতো কাজের ভেতর কিসে সুখ খুঁজে পান, এমন প্রশ্নে সুমী বলেন, প্রথমে একমাত্র ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র তামজীদ রহমান স্বপ্নকে পেলে সব দুঃখ ভুলে যাই। ভালো লাগে বাংলাদেশ বেতার খুলনা ও মাইক্রোফোনকে।
সুমী তার শিক্ষাগুরুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, কবিতার গুরু কাজল ইসলামের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের প্রতি। সব শিক্ষাগুরুর প্রতি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮
এমআরএম/এইচএ/