নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, গড়ে তুলেছেন ভাই-বোন ও সন্তানদের। স্বামী ও বাবার সংসার আগলে রেখেছেন তিনি।
বাংলানিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসমাউল হুসনা খান জানান, তার বাবা নুরু খান কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ১৯৭৪ সালে জন্ম হুসনার। চার ভাই-বোনের অভাব অনটনের সংসার ছিল তাদের। জীবিকার তাগিদে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সিলেট শহরে আসেন আসমাউল হুসনা।
১৯৮৮ সালে সেলাই শিখতে শুরু করেন। লেখাপড়া এসএসসি পর্যন্ত। ১৯৯০-৯১ সালে সিলেট মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে ৬ মাসের দর্জি বিজ্ঞান ট্রেডে প্রশিক্ষণ নেন।
ফেলে আসা দিনের স্মৃতি আউড়িয়ে আসমাউল হুসনা বলেন, বড় ভাই মারা যান সেই কবে! এরপর কতদিন না খেয়ে কেটেছে ইয়ত্তা নেই। তখন আত্মীয় স্বজনরাও অবহেলার চোখে দেখেছেন। বিয়ে-সাদিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াতও দেওয়া হতো না। এ জন্য দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে নামলাম।
তিনি বলেন, নানি মাকসুদুন্নেছার দেওয়া ১৪শ’ টাকা পুঁজি নিয়ে সেলাই মেশিন কিনে বাসায় ছায়া-ব্লাউজ সেলাই করে দিতেন দর্জি দোকানে। সেলাই করে দেওয়ার পর মজুরি ৪/৫ টাকাও অনেক সময় পেতেন না। কষ্টের উপার্জনে তিলে তিলে একটি দোকান নিলেন সিলেট প্লাজায়। মার্কেটের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নামকরণ করেন স্টার প্লাজা টেইলার্স। এরপর দোকানের চুক্তিনামা মহিলার নামে দেবে না মার্কেট মালিক। এক পর্যায়ে বুঝানোর পর দোকানের চুক্তিনামা তার নামে হয়।
নানা প্রতিকূলতা মাড়িয়ে ২০১৪ সালে স্টার ফ্যাশন হাউজ নামে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ওই প্রতিষ্ঠানে এখন ৬০ থেকে ৬৫ জন কর্মী কাজ করেন।
ব্যবসায় নেমেও মানুষের বৈরী আচরণ হুসনার পথচলায় মনে জেদ তৈরি করে দিয়েছে। ফলে পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। নগরীর জিন্দাবাজারের আল-হামরায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (টেইলার্স) করেন। ওখানে প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের প্রতিহিংসায় লাখ পাঁচেক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবুও পিছপা হননি তিনি।
এরই মধ্যে ১৯৯৪ সালে নগরীর আল মারজান মার্কেটের ব্যবসায়ী আবুল খায়েরের সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধেন। তাদের সংসারে আসে ফুটফুটে দুই পুত্র সন্তান। বড় ছেলে হাসান মাহমুদ অপি মদন মোহন কলেজে বিবিএ’র ছাত্র এবং ছোট ছেলে হুসাইন মাহমুদ রাফি জালালাবাদ ক্যান্টেনমেন্ট স্কুলের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
ব্যবসা করে আসমাউল হুসনা যে কেবল নিজেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা নয়। তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসা এবং চাকরির মাধ্যমে সফল নারীর সংখ্যা অন্তত অর্ধশত। তারা এই সিলেট শহরে এবং কয়েকজন নিজেদের গ্রামের স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রশিক্ষক হিসেবে আসমা অঙ্গরূপা নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়েছিলেন। অনেকেই সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সফল নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ২০১৬ সালে পেয়েছেন ওসমানী পদক, ২০১৫ সালে শেরে বাংলা পদক। সিলেটে ‘হাসন উৎসব ২০১৭’ উপলক্ষেও পদক পেয়েছেন তিনি। সবশেষ এবার সফল নারীদের ৫টি ক্যাটাগরিতে আসমা উল হুসনা ‘অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরিতে সরকারি স্বীকৃতি ‘জয়িতা’ পুরস্কার লাভ করেন।
নিজের মতো ছোট বোনকেও গড়ে তুলেছেন তিনি। তার সঙ্গে রান্না-বান্নায় জয়িতা পুরস্কার লাভ করেন তার ছোট বোন সাবরিনা। ২০১২ সালে তার বোন সাবরিনা খান যৌথভাবে পেয়েছিলেন সেরা স্কয়ারের রাঁধুনী পদক।
দুই বোন মিলে নগরীর আলমারজান মার্কেটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন সাবরিনা’স কিচেন। যেখানে সাবরিনা নিজেই শেফ’র কাজ করেন। পাশাপাশি ‘ও’ লেভেল সম্পন্ন করেছেন। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্টার গ্রুপের অন্তত সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে আসমাউল হুসনার।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের সাফল্য অর্জনে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে আসমা ও সাবরিনার বলেন, প্রত্যেক নারী কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত, তাদের পারিবারিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সমাজ থেকে এসব দূর করে সবাইকে ইতিবাচক হতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮
এনইউ/এমজেএফ