ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

প্রতিরোধের মার্চ-৫

ময়মনসিংহ জয়ে ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৯
ময়মনসিংহ জয়ে ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের লেকে প্লাষ্টিকের নৌকা। ছবি: বাংলানিউজময়মনসিংহ শহরের ব্রক্ষপুত্র নদঘেষা জয়নুল উদ্যান এলাকায় একটি বধ্যভূমি।

১৯৭১ | গৌরব ও প্রতিরোধের মার্চ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধুএর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ময়মনসিংহ প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে২৭ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিলময়মনসিংহ ছিলো হানাদারমুক্ত এবং স্বাধীনতারপর ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শত্রুসেনা মুক্ত হয়মাঝে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ২৩১ দিনছোট-বড় অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয় ময়মনসিংহের রণাঙ্গনেকোনো যুদ্ধে হানাদাররা চূড়ান্ত বিজয় পায়নি।

একাত্তরে ময়মনসিংহ ছিলো অপরাজেয়। যুদ্ধের সময়ে ময়মনসিংহের ইতিবৃত্ত নিয়ে ৫ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

পড়ুন ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির শেষ কিস্তি। ছবি তুলেছেন ডিস্ট্রিক্ট ফটো করেসপন্ডেন্ট অনিক খান

২৭ মার্চ, ১৯৭১। ভারতের একটি গণমাধ্যমের বরাতে খবর— শেখ মুজিবুর রহমান এক বার্তায় আজ বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এক গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের প্রচারিত বার্তা এখানে শোনা গেছে।

অপর খবরে ওই গণমাধ্যমটি লিখে, ২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ বেলা ১টায় ঢাকা ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ময়মনসিংহ উইং হেডকোয়ার্টারে ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে ডাকা হয়। বলা হয়, কথা বলার সময় সেখানে যেন কেউ (কোন বাঙালি) না থাকে।

ঢাকা থেকে ইপিআরের স্টাফ কর্নেল সিকান্দার খান ময়মনসিংহের কমর আব্বাসকে বলেন, বাঙালি ইপিআররা নিরস্ত্র থাকবে, তাদের ডিউটিতে দেওয়া যাবে না এবং অস্ত্রাগারের কোনো চাবি তাদের কাছে থাকবে না।

কিন্তু ময়মনসিংহে ওয়ারলেস অপারেটর ফরহাদ গোপন খবরটি গোপন রাখেননি। তিনি শেখ হারুন, বাবু মান্নানকে জানান। ২৭ মার্চ ভোর ৬টায় ফরহাদ খবরটি সুবেদার মেজর জিয়াউল হককেও জানান।

২৭ মার্চ রাত ১১টায় ঢাকার নির্দেশ অনুযায়ী ময়মনসিংহে বাঙালি ইপিআরদের খতম করার ‘চূড়ান্ত বার্তা’ পান কমর আব্বাস। পাকিস্তানি জেসিও-এনসিওদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৭ মার্চ দিনব্যাপী ষড়যন্ত্র চলে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে।

বাঙালিদের অফ ডিউটি, নিরস্ত্রকরণ, বড়খানায় সকলকে একসঙ্গে খাবারের জন্য ডাকা হয়। ব্যারাকের সামনে সশস্ত্র গাড়ি মোতায়েন করা হয়। সন্ধ্যা রাতেই ব্যারাকের আলো নিভিয়ে সকল বাঙালি সিপাহীকে ঘুমিয়ে পড়ার তাগিদ দেয় পশ্চিমা সিপাহীরা।

পাকিস্তানি ইপিআরদের রহস্যজনক তৎপরতার দিকে নজর রাখছিলেন শেখ হারুনরা। শেখ হারুন ময়মনসিংহের ভাবখালীর ছেলে। ইপিআর ফুটবল টিমের সদস্য ছিলেন। শহরের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিলো। খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, ঘেরাও অভিযানের তৎপরতার খবর ছিলো।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালি ইপিআরদের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করেছিলো। সেই সতর্কতা থেকেই তারা সেদিন পাকিস্তানিদের যে কোন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের প্রশ্নে ছিলেন সোচ্চার। রাত পৌনে ১২টার দিকে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের অন্ধকার আকাশে ব্যারেলাইট গানের আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

এটিই ছিলো বাঙালিদের খতম করার ‘কোড’। কিন্তু বিষয়টি বাঙালিদের নজর এড়িয়ে যায়নি। পাকিস্তানিরা হামলা করার আগেই বাঙালিরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয়ে যায় খাগডহর যুদ্ধ।

ট্রুপস ব্যারাক, উইং কমান্ডারের বাংলোসহ সমস্ত এলাকায় পাকিস্তানি ইপিআর সশস্ত্র অবস্থান নিয়েই ছিলো। অন্যদিকে সি-কোম্পানির এক প্লাটুন ইপিআর অস্ত্র সমর্পণ করেনি। তারা উইং কমান্ডারের বাংলোতে ডিউটিতে ছিলো। গার্ড কমান্ডার শফির কাছে থ্রি নট থ্রি ছিলো। বাকিরা ছিলো নিরস্ত্র।

উইং হেডকোয়ার্টারে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি ছিলো। রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার বড়ুয়া, সুলতান, বাঙালি ইপিআরদের সাথে যোগ দেন।

২৭ মার্চ রাতভর চলা যুদ্ধে ময়মনসিংহ শহর কেঁপে ওঠে। ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র জনতার সাথে বাঙালি ইপিআরদের যোগাযোগ ছিলো।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিক উদ্দিন ভূইয়া, অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন আকন্দ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আবেদ, সৈয়দ আব্দুস সুলতান, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, শামসুল হক, আবুল হাশিম, ভিপি হামিদ, ম. হামিদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের ভূমিকার কথা খাগডহর যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাঙালি ইপিআরদের স্মৃতিকথায় উঠে আসে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নবম খণ্ডেও এই তথ্য রয়েছে। সুবেদার এ কে এম ফরিদ উদ্দিন আহমদ ময়মনসিংহ শহর ও অন্যান্য স্থানের প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, ২৭ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস তাকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটি থেকে সরে স্ট্যান্ড ডাউন হতে নির্দেশ দেন। এই সময় দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়।

তিনি হাতিয়ার জমা না দেবার সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিকেলে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার মেজর নুরুল ইসলামের সাথেও কথা বলেন। যদিও যুদ্ধরাতে তিনি খাগডহর ছিলেন না। রাত পৌনে ১২টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ হয়।

দীর্ঘ এই যুদ্ধে ২২০ জন বাঙালি সিপাহী অংশ নেয়। অবাঙালি ১৩৮ জনের মধ্যে ১২১ জন নিহত হয়। ১৭ জন আত্মসমর্পণ করে। ময়মনসিংহ খাগডহর যুদ্ধে বাঙালিরা বিজয়ী হয়।

পতন হয় পশ্চিমা ইপিআরদের। অস্ত্রাগার থেকে উদ্ধার হয় ১ হাজার ৪৭২টি রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, ১ লাখ ৪৫ হাজার গুলি, ৩৬ হাজার নাইন এমএম গুলি ও স্টেইনগান।

২৯ মার্চ সকালে শহরের রাবেয়া হাইস্কুলে উইংয়ের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

সন্ধ্যায় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট শহরের রাজবাড়িতে একত্রিত হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় ময়মনসিংহ প্রতিরক্ষা ও ঢাকা আক্রমণের।

পরদিন ময়মনসিংহ থেকে সিপাহীরা ট্রেনযোগে ঢাকার জয়বেদপুরের উদ্দেশে রওনা হন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান দলটির নেতৃত্বে যোগ দেন। ২৮ মার্চ সকাল থেকে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা ছিলো বাঙালিদের দখলে।

ধৃত পাকিস্তানিদের ধরে নেওয়া হয়। পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্র বের করে ছাত্র জনতার হাতে দেওয়া হয়। উন্মুক্ত বাঙালিদের ধাওয়ার মুখে পড়ে পাকিস্তানি বিহারিরা।

৩০ মার্চ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা খবর দেয়, মুক্ত ময়মনসিংহের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়েছে আওয়ামী লীগের শাসকরা। আগরতলা থেকে পিটিআই/ইউএনআই জানায়, সমগ্র এলাকায় এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের পূর্ণ দখলে রয়েছে।

৩১ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট: উত্তর মধ্য রণাঙ্গণে ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে। ৪ এপ্রিল আনন্দবাজার লিখে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ সম্পূর্ণ নিজ দখলে রেখেছে। এসব স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে এবং ঢাকা ও রাজশাহীতে এখনো তীব্র যুদ্ধ চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৯
এমএএএম/এমজেএফ

আরও পড়ুন...

** বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
** মুক্তিকামী জনতার দখলে ময়মনসিংহ
** মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বিজয় ময়মনসিংহে
** শহর থেকে গ্রামে যুদ্ধের প্রস্তুতি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।