ঢাকা, সোমবার, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

গ্রাম-বাংলার প্রাণের উৎসব বৈশাখী মেলা

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৯
গ্রাম-বাংলার প্রাণের উৎসব বৈশাখী মেলা

সিরাজগঞ্জ: ‘আসে উৎসব-জাগে উল্লাস, সাজে নবপল্লবে বনবিথী। নীল গগনে সাদা আর কালো মেঘের খেলা নিরবধি। প্রলয় হুংকার কত ভয়ংকর-ঝড়ে বৃষ্টি আনে তুষ্টি। গাঁয়ের মাঠে প্রাণের মেলায় সাজিয়াছে মন্ডা-মিষ্টি।’

নবরূপে সজ্জিত প্রকৃতির মাঝে ঘন কালো মেঘের গর্জন, সঙ্গে রং-বেরঙের উৎসব। এমন চিরায়ত রূপ নিয়ে বাংলায় আসে বৈশাখ, শুরু হয় নতুন বছর।

আর নববর্ষ বরণ উৎসবকে আকর্ষণীয় করে তোলে বৈশাখী মেলা।  

১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি, হিজরি, চন্দ্র ও সৌর সনকে ভিত্তি করে বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হওয়ার পর মোঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন ও মাস বৈশাখকে বরণ করতে তখন মেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। কালেক্রমে সেটির নাম হয় ‘বৈশাখী মেলা’।

খেলনা টমটমের টুংটাং শব্দ, তালপাতার বাঁশির পু-পু-পু সুর, নাগরদোলায় দোল খাওয়া শিশু-কিশোরদের কলরবের সঙ্গে পুতুল নাচের আসর থেকে মাইকে ভেসে আসা লোকজ গান আর ঢাক ঢোলের শব্দ নিয়েই গ্রাম-বাংলায় বসে বৈশাখী মেলা। মেলায় থাকে লোকজ খাদ্যদ্রব্য মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, রসগোল্লা, খই-চিড়া বাতাসা। গাঁয়ের বধূদের জন্য কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা, রঙিন ফিতা, প্রসাধনীর সারি সারি দোকান। কারুপণ্য, কুটির শিল্প, হস্তশিল্পসহ নানা পণ্য ছাড়াও মাটির তৈরি পুতুল, কাঠের গাড়ি, বাঁশের কুলা-চালুনসহ নানা ধরণের শিশু-কিশোর খেলনা সামগ্রীর পসরা সাজায় দোকানিরা।

পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রাগান, কবিয়াল গান, লাঠি খেলা, যাদু প্রদর্শনী ইত্যাদি বিনোদনে মুখরিত থাকে মেলা প্রাঙ্গণ। আর মেলার এ দিনটির জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকে গাঁয়ের বধূ, শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষ।
বৈশাখী মেলা
মেলায় যেতে যেতে গাঁয়ের মেঠো পথে শিশু-কিশোরদের দুরন্তপনায় ছুটে চলা ও পাগলা হাওয়ায় দোল খাওয়া সবুজ ধানের ক্ষেতে ভাই-বোনের লুকোচুরি খেলা আনন্দটা আরও বাড়িয়ে দেয়। আর মেলা থেকে ফেরার পথে তালপাতার বাঁশি, খেলনা টমটম গাড়ি ও কিশোরীর হাতে কাচের চুরির ঝনঝন আওয়াজে মুখরিত থাকে পথ-প্রান্তর।

সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার কালিয়ায় প্রতিবছরই বসে এমন এক ঐতিহ্যবাহী মেলা। শত শত বছর ধরে চলে আসা মেলাটি উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও সয়দাবাদ, শিয়ালকোল ও বাগবাটি কাঠের মেলাটিও ঐতিহ্যপূর্ণ। এসব মেলা একদিন থেকে সাত দিনব্যাপী হয়ে থাকে। বৈশাখ উপলক্ষে কামারখন্দের বিয়ারা ও উল্লাপাড়ার আঙ্গারু মেলাটি চলে মাসব্যাপী। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রত্যেকটি শনিবারই এ মেলা দু’টি অনুষ্ঠিত হয়। দুই থেকে আড়াইশ বছর ধরেই এ মেলা চলে আসছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।

এছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তি আর বৈশাখ উপলক্ষে অসংখ্য মেলা বসে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জ। শতাব্দী ধরে চলে আসা মেলাগুলোর কথাই লোকমুখে বেশি প্রচারিত। এর মধ্যে সদর উপজেলার কালিয়া, শিয়ালকোল, সয়দাবাদ, বাগবাটি, কাজিপুরের ভানুডাঙ্গা, চরকাদহ, মাথাইলচাপড়, নাটুয়ারপাড়া, তাড়াশের বারুহাস, গুরমা, উল্লাপাড়ার আঙ্গারু, লাহিড়ীপাড়া, রায়গঞ্জের সিদ্ধেশ্বরী, গুইয়াবানি, ভূইয়াগাঁতী ও কামারখন্দের বিয়ারাসহ জেলার অর্ধ শতাধিক স্থানে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা বসে।

বৈশাখী মেলা এখন গ্রাম থেকে শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। জেলা ও উপজেলা শহরের নাগরিকরাও এখন বৈশাখী উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন। সকালে মঙ্গল শোভাযাত্র আর শহরের বিভিন্ন স্থানে পান্তা-ইলিশের মেলার পাশাপাশি লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই নববর্ষ পালন করা হয়।

কালিয়া গ্রামের বাসিন্দা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গাজী সোহরাব আলী সরকার বাংলানিউজকে বলেন, কালিয়ার মেলাটি ঐতিহ্যপূর্ণ। মেলাটি একসময় চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত চলত। মেলা উপলক্ষে কালিয়াসহ আশপাশের অন্তত ৫০ গ্রামে চলতো উৎসব। বাড়ি বাড়ি থাকতো আত্মীয়-স্বজনের ভিড়, মেয়ে ও জামাইদের কলরব।  

তিনি বলেন, মেলায় আমরা যাত্রাপালা করতাম। কোনো কোনো বছর চলচ্চিত্রের শিল্পীদেরও এ যাত্রায় অভিনয় করানো হতো। এছাড়া পুতুল নাচ, সার্কাস, সাপ খেলা, লাঠিখেলা, বাদর নাচসহ নানা চিত্ত বিনোদনের আয়োজন থাকতো মেলায়।  

তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্তমানে মেলাটির ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। জেলা প্রশাসন থেকে মেলার অনুমোদনও দিতে নানা গড়িমসি করা হয়।

ঐতিহ্যবাহী আঙ্গারু মেলা সম্পর্কে সলঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বাংলানিউজেক বলেন, প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ এ মেলাটি বসতো। মেলার জন্য কোনো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জানান দিতে হয় না। দূর-দূরান্তের মানুষ তিথি অনুযায়ী আগেই এসে জমায়েত হতো।

পহেলা বৈশাখে অপর ঐতিহ্যবাহী মেলা তাড়াশের বারুহাস। চলনবিলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। বারুহাস ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোক্তার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, অর্ধশত মাইল দূর থেকে পার্শ্ববর্তী বগুড়া ও নাটোর জেলার মানুষও এ মেলায় কেনা-বেচা করতে আসেন। এক সময় রাস্তাঘাট না থাকায় দুর্গম অঞ্চলে বসা এ মেলায় মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে মানুষ আসতেন।

চালিতাডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান মুকুল, কালিয়া হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সবুর ও সয়দাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান নবিদুল ইসলাম বলেন, এক সময় উৎসবমুখর থাকলেও ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো বর্তমানে বন্ধ হতে চলেছে। শত শত বছর ধরে চলে আসা মেলাগুলোর অনুমোদন দিতেও চাচ্ছেন না স্থানীয় প্রশাসন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝেও ক্ষোভও রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বাংলানিউজকে বলেন, বৈশাখী মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষায় এখনো স্বগর্বে টিকে রয়েছে বৈশাখী উৎসব ও মেলা। এছাড়াও বাঙালিরা চৈত্র মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন তিথিতে মেলার আয়োজন করে। সেটার পরিপূর্ণতা লাভ করে চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখের মেলার মধ্য দিয়ে। বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এ বৈশাখী মেলায় সব শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ সব বয়সীরা অংশ নেয়।

তিনি বলেন, কালের বিবর্তনে চৈত্র সংক্রান্তি কিংবা বৈশাখী মেলাগুলো ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এসব মেলাকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু চক্র মদ, জুয়াসহ নানা অসমাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসায় তা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনও সহজে মেলার অনুমোদন দিতে চাচ্ছে না। তবে কিছু দুষ্কৃতিকারীদের জন্য হাজার বছরের ঐতিহ্য বন্ধ হয়ে যাক-এটা কখনোই কাম্য নয়। গ্রামীণ বৈশাখী মেলাগুলো স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দাবি জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুন নাহার সিদ্দিকা বাংলানিউজকে বলেন, আমি এখনো কোন মেলার অনুমোদন দেই নাই। অনুমোদন ছাড়া কেউ মেলার আয়োজন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

তিনি বলেন, প্রাচীনকাল ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী মেলা চালানোর জন্য কেউ অনুমোদন চাইলে বিবেচনা করবো।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৯
জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।