ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনা সন্ধানীতে লাল রক্তের কালো ব্যবসা!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৯
খুলনা সন্ধানীতে লাল রক্তের কালো ব্যবসা! সন্ধানী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার। ছবি: বাংলানিউজ

খুলনা: ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। একারণে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর পরীক্ষা হচ্ছে বিনামূল্যে, বেসরকারি হাসপাতালেও ফি বেঁধে দিয়েছে সরকার। কিন্তু, ডেঙ্গুকে পুঁজি করে রমরমা ব্যবসায় মেতেছে খুলনার কিছু বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক। এদের মধ্যে সবার আগে নাম আসছে সন্ধানী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দুই-তিনগুন বেশি ফি নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষার নামে কালো ব্যবসা শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
 

গত মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গুণতে হয়েছে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু, তাতেও দমে যায়নি প্রতিষ্ঠানটি।

উল্টো ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ! রোগীরা এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন বাধ্য হয়েই।

অভিযোগ উঠেছে, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক তাদের রোগীদের সন্ধানী থেকে পরীক্ষা করাতে বলেন। এর বিনিময়ে মোটা অংকের কমিশন পান তারা। এছাড়া সন্ধানীর টেস্টের মান নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।  

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আরাফাতুল আলম ও ইমরান খান।

ইমরান খান বাংলানিউজকে বলেন, সরকার নির্ধারিত ডেঙ্গু রোগের সিবিসি পরীক্ষার মূল্য ৪০০ টাকা। সন্ধানী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার রোগীদের কাছ থেকে এরচেয়ে অনেক বেশি মূল্য নিচ্ছিল। এ বিষয়ে আমাদের কাছে একাধিক অভিযোগ আসে। এর প্রেক্ষিতে অভিযান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৭/৮ জন ভুক্তভোগী অভিযানের সময় জানান, তাদের কারও কারও কাছ থেকে ৮০০, ১২০০, ১৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।

অভিযানের পর ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে ক্লিনিকটি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ কাজের জন্য আবারও অভিযান পরিচালনা করতে হবে। আর, সত্যতা পেলে এবার জরিমানার সঙ্গে সঙ্গে কারাদণ্ড দিতে হবে।

বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে মহানগরীর বাবু খান রোডের সরেজমিনে দেখা গেছে, ক্লিনিকটিতে রোগীদের ভিড় নেই।

জ্বরে আক্রান্ত ভাগ্নিকে খুলনা শিশু হাসপাতাল থেকে সন্ধানীতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে এনেছেন আজিজুল। তিনি জানতেন না, এখানে ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ আছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বাধ্য হয়েই শিশুটিকে নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে তাকে।  

আজিজুল বাংলানিউজকে বলেন, রূপসার আইচগাতী থেকে জ্বরে আক্রান্ত দুই বছরের ভাগ্নি খুশিকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানকার চিকিৎসক ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য সন্ধানীতে পাঠিয়েছেন। এখানে এসে দেখি, পরীক্ষা বন্ধ। ক্লিনিক থেকে বলা হচ্ছে, পরীক্ষা করার ওষুধ নেই।

ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ, ভাগ্নিকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন মামা।  ছবি: বাংলানিউজ

তিনি বলেন, আমি শ্রমিক মানুষ। দিন আনি, দিন খাই। কোথায় কিসের পরীক্ষা হয়, বলতে পারি না। বাবা ফেলে রেখে যাওয়া শিশুটিকে নিয়ে এখন কোথায় যাবো, বুঝতে পারছি না।

আজিজুলের মতো অনেকেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে না পেরে ফিরে গেছেন। কয়েকজন রোগীর স্বজন জানান, জরিমানার প্রতিবাদে ইচ্ছা করেই ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে সন্ধানী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলু বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ওষুধ না থাকায় তা আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ঢাকায় ওষুধ আনতে পাঠানো হয়েছে।

পরীক্ষার জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা টানানো নেই কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, টানানো আছে।

বুধবার (৩১ জুলাই) ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষা করতে কতজন এসেছেন- জানতে চাইলে বাবলু বলেন, আমি এটা জানি না। রিসেপশন বলতে পারবে। আমার কাজ, ক্লিনিকে কোনো ঝুট-ঝামেলা হলে সেটা দেখাশোনা করা।

জরিমানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ন্যাশনাল হাসপাতালে তো চার-পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। আমাদের আল্লাহর রহমতে অল্পের ওপর দিয়ে গেছে।

এদিকে, ডেঙ্গু পরীক্ষায় বেশি অর্থ নেওয়ায় সন্ধানী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারকে জরিমানা বিষয়ে ‘ডেঙ্গু পরীক্ষা: খুলনায় ৮ সেবা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা’ শিরোনামে বাংলানিউজে সংবাদ প্রকাশের পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়ম ও অভিযোগ তুলে ধরেছেন।

সন্ধানীর ডেঙ্গু পরীক্ষা নিয়ে অমানবিক ব্যবসা সম্পর্কে তমা কাজী নামে একজন লিখেছেন, লাল রক্তে কালো ব্যবসা! ওরা চিকিৎসার নামে কসাইখানা খুলেছে।

মিলি আক্তার লিখেছেন, ওরা ব্যবসায়ী, সেবাদাতা না।

অলকা দাস নামে এক জন ফেসবুকে লিখেছেন, ২৫০ বেড হাসপাতালের চিকিৎসকরা সব পরীক্ষার জন্য সন্ধানীতে রেফার করেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, গরিব একটা মেয়ের রক্ত টেস্ট করাতে বলেছে, যার মূল্য ১২ হাজার ৪শ’ টাকা চেয়েছে সন্ধানী। একজন পরিচিত চিকিৎসক ল্যাবএইডে ফোন করলে একই দাম চাইলো। পরে, নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, ‘আমার জন্য কত?’ সব শুনে বললো, স্যার ৭ হাজার ৫শ’ টাকায় হবে। ভাবা যায়! একটা পরীক্ষা করতে রেফারকারী চিকিৎসকের জন্য সন্ধানীকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়! আমরা কোথায় আছি?

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৯
এমআরএম/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।