একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, ওই দুই নেতার সিন্ডিকেটই রহস্যজনক কারণে গত ১০ বছর ধরে বিমানবন্দরে পার্কিং কাজের ইজারা পাচ্ছে। কতিপয় কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে বিমানবন্দরের পার্কিং হাতে রেখে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতার সিন্ডিকেট।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুযায়ী, পাঁচ লাখ টাকার বেশি সরকারি স্থাপনা ইজারা দিতে হলে দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে দরপত্র ছাড়াই ১০ শতাংশ মূল্য বেশি দিয়ে বাড়তি একবছর নবায়ন করছে ইজারাদাররা। এছাড়া সর্বোচ্চ দরদাতা না হয়েও দুই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানই ঘুরে ফিরে বারবার পাচ্ছে ইজারা। ফলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশেনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের নেতা মো. শফিকুল ইসলাম শফিকের মালিকানাধীন মেসার্স শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সকে ২০ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৭ কোটি টাকা মূল্যে দুই বছরের জন্য বহুতল কার পার্কিং ইজারা দেওয়া হয়েছে। যার মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালের ৩০ জুন। পরে ১০ শতাংশ ফি দিয়ে আরও এক বছর নবায়ন করার সুযোগ পাবে এ প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসকে প্রথম তিন ঘণ্টার জন্য ১০০ টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়া একটু বিলম্ব হলেই ৪০ টাকা অতিরিক্ত গুণতে হচ্ছে। নিয়মের বাইরে এখানে প্রায় ৪০-৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত নিচ্ছেন ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা
অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের কার পার্কিংও তারই মালিকানাধীন মেসার্স অথৈ এন্টারপ্রাইজ ইজারা নিয়েছে। ৯৭ লাখ টাকার বিনিময়ে দু’বছর মেয়াদে নতুন করে এ ইজারা নিয়েছে শফিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান। এখানে কার ও মিনিবাস প্রথম তিন ঘণ্টা ১৫০ টাকা, জিপ, ট্যাক্সি ক্যাব ও মাইক্রোবাস প্রথম তিন ঘণ্টা ৮০ টাকা, বেবি ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেল প্রথম তিন ঘণ্টা ২৫ টাকা ও বাইসাইকেল প্রথম তিন ঘণ্টা ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এই কার পার্কিংয়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানা অসদাচরণের অভিযোগও রয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক বহির্গমন কনকোর্স হলও (দ্বিতীয় তলা) নামমাত্র মূল্যে ইজারা পেয়েছে মেসার্স শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স। কনকোর্স হলে দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে নিচ্ছে। এছাড়া ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশের বেলায় টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও সেখানে প্রবেশের জন্যও ইজারা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতারণা করে টিকিট ছাপিয়ে জনপ্রতি ৩০০ টাকা নিচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা শফিকুল ইসলাম ২০১০ সাল থেকেই বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা নিয়মিত ইজারা পাচ্ছেন। সিভিল এভিয়েশনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে গত ১০ বছর এককভাবে ইজারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব নিয়ন্ত্রণ করেন শফিকুলের ছোট ভাই জুয়েল।
আগমনী কনকোর্স হল (নিচতলা) ২০ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্সসহ প্রায় ৫ কোটি টাকায় ইজারা নিয়ে কাজ করছে আরেক আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহিদুর রহমান খানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তানহা ট্রেডার্স। কনকোর্স হলে দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য জনপ্রতি ৩০০ টাকা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ক্যানেপি এলাকায় প্রবেশের বেলায় টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। অথচ ক্যানোপি এলাকায়ও প্রবেশের জন্য ইজারা প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করে টিকিট ছাপিয়ে জনপ্রতি ৩০০ টাকা নিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে কতিপয় কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে ইজারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তানহা ট্রেডার্সের বিরুদ্ধেও।
সোমবার (১৯ আগস্ট) নরসিংদীর আবুল হোসেন তার কাতারফেরত ভাইকে নিতে আসেন বিমানবন্দরে। তিনি ১ নম্বর ক্যানোপি পার্কিং এলাকায় যেতে চাইলে তার আগেই কনকোর্স হল ইজারাদার কর্মীরা আবুল হোসেনের কাছে অবৈধভাবে ৩০০ টাকার টিকিট দাবি করেন। বাধ্য হয়েই ৩০০ টাকার টিকিট কেনেন তিনি। তার মতোই প্রতারণার শিকার হয়ে টিকিট কিনে ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশ করতে হচ্ছে বিদেশফেরত যাত্রীদের স্বাগত জানাতে আসা স্বজনদের।
কয়েক দিন আগে মোটরসাইকেল রাখাকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে জনৈক ব্যক্তিকে মারতে উদ্যত হন এক কর্মচারী। পরে ওই ব্যক্তি গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয় দেওয়ার পর মেসার্স অথৈ এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার নাসির উদ্দিন ক্ষমা চেয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন।
ভুক্তভোগী কয়েকজনের ভাষ্যে, শাহজালাল বিমানবন্দরে গাড়ি পার্কিং এলাকায় ইজারা প্রতিষ্ঠানের লাইনম্যানরা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা চাহিদা মতো বখশিস না পেলে গাড়ি পাঠিয়ে দেন পেছনের সারিতে।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন শাহজালাল বিমানবন্দরে ওঠানামা করে ১৪০-১৫০টি ফ্লাইট। যাত্রীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। যাত্রীদের বিদায় ও অভ্যর্থনা জানাতে আসেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ। বছরে গড়ে ৬০ লাখ মানুষ এ বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করেন। ফলে পার্কিংসহ গমনাগমনের বিভিন্ন স্থানে চলছে বড় ধরনের বাণিজ্য।
এসব বিষয়ে জানতে মেসার্স শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম শফিকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলে তিনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন।
শফিকুল ইসলামের ছোট ভাই জুয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পার্কিংয়ে বেশি টাকা রাখা হয় এমন প্রমাণ দিতে পারলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায় কখনোই রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করি না। আমরা সর্বোচ্চ দরদাতা, তাই বারবার ইজারা পাই। ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের অভিযোগ নেই।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইজারাদার ওয়াহিদুর রহমান খান বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন, ক্যানোপি এলাকায় প্রবেশের জন্য টিকিটের মাধ্যমে বাড়তি কোনো টাকা নেওয়ার হয় না।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বিদেশে থাকায় এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৯
টিএম/এইচএ/