অথচ দেখা গেছে মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানীর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমগতির এই অটোরিকশার চলাচল। গতবছর ঈদুল আজহার ছুটিতে নাটোরে বাস-লেগুনা সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহী-ঢাকা, রাজশাহী-নওগাঁ ও রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে দিন-রাত সমানতালে অটোরিকশা চলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বড় যানবাহনগুলোর সঙ্গে যাত্রী তোলা নিয়ে অসম প্রতিযোগিতাও করছে। বেশি ভাড়ার আশায় শহরের মধ্যে চলাচল না করে কেউ কেউ রিজার্ভ ভাড়া নিয়ে মহাসড়ক হয়ে আশপাশের উপজেলাসহ নিকটবর্তী জেলাগুলোতে যাত্রী পরিবহন করছে। তাদের বেশিরভাগ চালকেরই আবার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। মহাসড়কের প্রবেশ মুখগুলোতে পুলিশ থাকলেও তারা কেবল মোটরসাইকেলের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই নিয়েই ব্যস্ত। তাদের পাশ দিয়ে অটোচালকরা নির্বিঘ্নে চলাচল করে।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ রাজশাহী জেলা শাখা কমিটির সভাপতি তৌফিক আহসান টিটু বলেন, ‘মহাসড়কে দ্রুত এবং ধীরগতির বাহন একসঙ্গে চলাচল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মহাসড়কে যদি বিভিন্ন গতির যানবাহন একসঙ্গে চলে এবং সেগুলোর মধ্যে যদি গতির পার্থক্য বেশি হয়, তাহলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তার কথায়, এ ধরনের দুর্ঘটনারোধে মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করতেই হবে’।
তবে রাজশাহী উইমেন চেম্বারের চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা রোজেটি নাজনীন বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা লেগুনা এবং নসিমন-করিমনের মতো বাহনগুলো গ্রামীণ সমাজের মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এতে সময় এবং খরচ দুটোই কম লাগে। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা না করে এসব বাহন বন্ধ করা ঠিক হবে না বলেও মনে করেন তিনি’।
একইভাবে রাজশাহী মহানগর অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম এমন নিষেধাজ্ঞাকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘মাথা ব্যথা হলে মাথা কাটতে হবে? না তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না। ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে হাজার হাজার অটোরিকশা চালক-মালিকের ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও সংশোধ হওয়া জরুরি। সেই পর্যন্ত রুটি-রুজির তাগিদে অটোরিকশা চালকরা মহাসড়কে থাকুক বলেও মন্তব্য করেন এই শ্রমিক নেতা’।
আর রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মনজুর রহমান পিটার বলেন, তারা দীর্ঘদিন থেকে মহাসড়কে কমগতির ছোট যানবাহনগুলোর চলাচল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন। কারণ দুর্ঘটনার জন্য এই যানবাহনগুলো অনেকাংশেই দায়ী। বাস মালিক-চালকরা তাই এই নিয়ে আন্দোলনও করে আসছেন। মাঝেমধ্যে ধর্মঘটও ডাকা হয়। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে ছোট যানবাহন চলাচল করছেই। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) ইফতে খায়ের আলম বলেন, মহাসড়কে যেন কোনো ধরনের অটোরিকশা চলাচল করতে না পারে সেই ব্যাপারে নির্দেশনা আছে। রাজশাহী পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ সব থানাকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের পুঠিয়া এলাকায় অটোরিকশা আটক করে পুকুরে ফেলেও দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। এছাড়া মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধে নিয়মিতভাবে অভিযান চালানো হয় বলেও জানান জেলা পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বাংলানিউজের চাঁপাইনবাবগঞ্জ করেসপন্ডেন্ট একেএস. রোকন জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কে অটোরিকশার চাপে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দুই লেনের দীর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার মহাসড়কে সারক্ষণই দুইটি সারি দখল করে থাকে অটোরিকশা। এর মধ্যে একটি সোনামসজিদ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী অটোরিকশার সারি এবং অপরটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সোনামসজিদগামী। এতে মহাসড়ক সংকুচিত হয়ে ভারী যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
বিশেষ করে মহাসড়কের ওপরে যত্রতত্র অটোরিকশাগুলো আকস্মিকভাবে দাঁড়িয়ে ডান দিক থেকে লোক ওঠানামা করায় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও মহাসড়কে ভটভটি, ট্রলি, মোটরচালিত রিকশাভ্যান এবং অন্যান্য অযান্ত্রিক যান চলাচল করায় মহাসড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
সদর উপজেলার দেবীনগর গ্রামের অটোরিকশা চালক সোবহান জানান তারা পেটের দায়ে যাত্রী চাহিদার কথা বিবেচনা করে মহাসড়কে চলাচল করে থাকেন। অন্যদিকে শিবগঞ্জের দুর্লভপুর এলাকার অটোরিকশা চালক নজরুল জানান, শিবগঞ্জ চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশে বিকল্প রাস্তা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে মহাসড়কে চলাচল করছেন।
এদিকে, শিবগঞ্জ ট্রাক ও মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সোনামসজিদ মহাসড়কে অযান্ত্রিক যানের সংখ্যা এত বেশি যে ভারী যানবাহনগুলো ঠিকমত চলতেই পারছে না। এছাড়াও অযান্ত্রিক যানবাহন অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলাচল করার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাই এ মহাসড়কটিতে যান চলাচলে দ্রুত একটি নিয়মের মধ্যে আনা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার টি.এম মোজাহিদুল ইসলাম জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কের অবৈধ যান নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সর্বপ্রথম অটোরিকশাগুলোর ডানপাশ বন্ধ করার পাশাপাশি অপ্রাপ্তবয়ষ্ক অটোরিকশাসহ যেকোনো অযান্ত্রিক যানবাহন চালকের বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে অভিযান চালানো হয়।
নওগাঁ করেসপন্ডেন্ট তৌহিদ ইসলাম জানান, তীব্র যানজটে নাকাল হয়ে পড়েছে নওগাঁ শহরবাসী। শহরে দিনদিন বেড়েই চলছে অটোরিকশা চলাচল। পৌরসভার দেওয়া তথ্য মতে বর্তমানে শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ১ হাজার ১শ’টি এবং ব্যাটারিচালিত আটোরিকশা ভ্যানের সংখ্যা ৫শ’টি।
শহরের লিটন ব্রিজের পূর্ব দিকের রাস্তার উত্তর পাশে সিএনজি ও অটোরিকশাগুলো রাস্তার ওপর রাখা হয়। ফলে দিনের পুরো সময়জুড়েই যানজট লেগে থাকে। পাশাপাশি শহরের বাটার মোড়, সরিষাহাটির মোড়, ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যানজট নিত্য সমস্যা।
নওগাঁর ট্রাফিক সার্জেন্ট গোলাম সারোয়ার জানান, শহরের যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের কোনো গাফিলতি নেই। শহরে যানজটের প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। সকাল হলেই শহরের আশপাশের এলাকা থেকে এগুলো শহরে ভেতরে ঢুকে যায়। ফলে দিনের বেলা যানজট লেগেই থাকে। তারা তাদের কিছু বলতে পারেন না। কারণ অটোরিকশাগুলো পৌরসভার অনুমতি নিয়ে চলাচল করছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে নওগাঁ পৌরসভার মেয়র নজমুল হক সনি বলেন, পৌরসভার অনুমতি ছাড়াও শহরে বহু অটোরিকশা চলাচল করছে। তবে এদের জন্য জেলা ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন মাঠে একটি স্ট্যান্ড করলে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই কাজ শুরু করবেন বলেও জানান নওগাঁ পৌর মেয়র।
সিরাজগঞ্জ করেসপন্ডেন্ট স্বপন চন্দ্র দাস জানান, ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি এড়িয়েই সিরাজগঞ্জের মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও অটোরিকশাভ্যান চলাচল করছে। তিন চাকার এ যানবাহন চলাচল করায় মাঝে মধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট আর ঘটে যাচ্ছে ছোট বড় দুর্ঘটনা।
মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শত শত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে। তবে এসব যানবাহন যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ীই চলাচল করতে হচ্ছে। দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার সড়কে যাতায়াতের জন্য বাস বা ভারী কোনো যানবাহন না থাকায় অটোরিকশার ওপরেই স্থানীয় যাত্রীরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, সব মহাসড়কেই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও উল্লাপাড়া মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত এসব যানবাহনে জরিমানা করছি। জরিমানা দেওয়ার দু’দিন পর থেকে আবারও তারা মহাসড়কে আসছে।
জয়পুরহাটের ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট শহিদুল ইসলাম সবুজ জানান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার শহর জয়পুরহাট। বৈধতা না থাকলেও প্রতিদিনই বাড়ছে অটোর সংখ্যা। বর্তমানে এসব অটোরিকশা জয়পুরহাট-বগুড়া, জয়পুরহাট-আক্কেলপুর, জয়পুরহাট-হিলি ও জয়পুরহাট-ধামইরহাট আঞ্চলিক মহাসড়কে চলছে মহাসমারোহে।
অদক্ষ চালক আর প্রশাসনের উদাসীনতায় ইচ্ছামতো চলছে অটোগুলো। ফলে শহরের পাশাপাশি প্রায়ই এসব আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। এছাড়াও সবসময়ই যানজট লেগে থাকছে। আর এ ব্যাপারে পৌর কর্তৃপক্ষও উদাসীন।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, আঞ্চলিক সড়কগুলোতে অবৈধ এসব অটোরিকশা বন্ধে পৌরসভাসহ স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
জয়পুরহাট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মুহাম্মদ আবু মুসা জানান, বেকারত্ব ঘোচাতে যুব সমাজ আজ অটোরিকশা বেছে নিয়েছে। তাদের নির্দিষ্ট সড়ক ব্যবহার করতে বলা হলেও কিছু কিছু চালক আঞ্চলিক সড়কগুলোতে যাত্রী পরিবহন করছেন।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ উজ্জল কুমার রায় বলেন, সড়ক দুর্ঘটনারোধে আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও যদি কেউ চালানোর চেষ্টা করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ শহীদ আলম বলেন, নজরদারি এড়িয়েই এসব যান চলাচল করছে। তারা প্রতিদিনই তিন চাকার যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। কিন্তু একেবারে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৯
এসএস/জেডএস