লোকমান আলী লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীর বারঘড়িয়া আদর্শপাড়া গ্রামের মৃত আবদার আলীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হওয়া লোকমান আলীকে যৌবন বয়স পর্যন্ত অভাবনামক দানবটি ছুঁতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে অভাবের তাড়নায় স্ত্রী নুরনাহার ১৪ দিনের এক ছেলেসহ চার সন্তানকে ফেলে অন্যের ঘরে পাড়ি জমান। সেই থেকে ৪ সন্তান ও মা নবিয়ন নেছাকে নিয়ে নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হয় লোকমান আলীর। এক বেলা চা ও আরকে বেলা হালকা ডাল ভাত খেয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে চার সন্তানকে লেখা পড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রামের এ জীবনে বর্তমানে তার একমাত্র মেয়ে প্রভাষক, বড় ছেলে সদ্য বিসিএস স্বাস্থ্যে উত্তীর্ণ হয়ে যোগদানের অপেক্ষায় এবং মেঝ ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করে বিসিএসের প্রস্তুতিতে নিচ্ছেন ও ছোট ছেলে স্নাতক শাখায় অধ্যায়ন করছেন।
কষ্টেভরা জীবনে নিজের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেই খান্ত হননি লোকমান আলী। বরং চরাঞ্চলের শিশুদের বিনামূল্যে সকাল-বিকেল পড়াচ্ছেন তিনি। এজন্য বাড়ির একটি ঘরকে পাঠশালা বানিয়ে মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে পরম যত্নে পড়াচ্ছেন তিনি। শিক্ষার্থীরা কেউ লোকমানকে দাদু, কেউ চাচা আবার কেউ ভাইয়া ডাকে। ব্লাকবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেন ঘরের টিনের দরজা। শুধু পড়াচ্ছেন না, গরীব ছেলে-মেয়েদের খাতা, কলম, শিশুদের মুখরোচক খাবার ও কখনো পোশাকও কিনে দিচ্ছেন নিজের টাকায়। নিম্ন মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো লোকমান আলীর এমন শিক্ষানুরাগী আচরণে মুগ্ধ ও অভিভূত চরাঞ্চলের মানুষ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোকমান আলী এখন গ্রামটির ‘আলোর বাতি ঘর’।
লোকমান আলী বাংলানিউজকে বলেন, জীবনে শেষ বলে কিছু নেই। শেষ থেকেই শুরু করতে হয়। কষ্ট জীবনের একটা অংশ মাত্র। কষ্ট না করলে জীবন রঙিন হয় না। শত কষ্টের মধ্যেও অর্থাভাবে নিজের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে দেইনি। তাই চরাঞ্চলের শিশুরা যেন অর্থের অভাবে ঝরে না পড়ে সেজন্য ১০ বছর ধরে এ প্রচেষ্টা করছি। যাতে চরাঞ্চলের ছিন্নমূল পরিবারের শিশুরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে সকাল-বিকেলে দুই শিফটে বর্তমানে প্রায় ৭০ জন শিক্ষার্থী আমার অবৈতনিক কোচিংয়ে লেখাপড়া করছে। আগে মাদুর বিক্রির টাকায় এখন সন্তানের আয়ের অংশে গরীব শিক্ষার্থীদের খাতা কলমের পাশাপাশি পোশাকও দেয় সাধ্যমত। মূলত সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল পরিবারে শিশুদের সুন্দর শৈশব-কৈশোর গড়ে তুলতে এমন উদ্যোগ।
লোকমান আলীর শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা নিপু, জান্নাতি ও সুমাইয়া বাংলানিউজকে জানায়, কোনো টাকা ছাড়াই পড়ার সুযোগ পেয়ে সময়মত সমবেত হয় তারা। খাতা-কলম বা পোশাকই নয়, ক্ষুধা লাগার কথা শুনলেই ঘরে যা থাকে খেতে দেন লোকমান দাদু।
লোকমান আলীর বৃদ্ধ মা নবিয়ন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, অনেক দিন নিজের খাবার অন্যকে দিয়ে পানি খেয়ে রাত কাটিয়েছে লোকমান। অভাবের তাড়নায় যে ঘর ছেড়ে পুত্রবধূ পালিয়েছে, সেই ঘর আজ গ্রামের শিশুদের কোলাহলে মুখরিত। পুরো গ্রাম জুড়ে সন্তানের প্রশংসা শুনে মা হিসেবে নিজেকে খুব গৌরবন্বিত মনে করি।
ওই গ্রামের কলেজ শিক্ষক রবিউল আলম বাংলানিউজকে বলেন, লোকমান আলীর মত সাদা মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই তবুও চার সন্তানকে মানুষ করার পাশাপাশি গ্রামের শিশুদের শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করে গ্রাম জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানরা যা করতে পারেননি, অর্ধশিক্ষিত ও ভূমিহীন এ লোকমান আলী তা সম্ভব করে উচ্চ শিক্ষিতদের অবাক করে দিয়েছেন।
দক্ষিণ বালাপাড়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল বাতেন ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, না খেয়ে থাকলেও লোকমান আলী কারো সাহায্য নেন না। পুরষ্কার স্বরূপ তার মেধাবী চার সন্তানকে ফরম পূরণসহ সব বিষয়ে ছাড় দেওয়া হতো। অন্যের জমিতে আশ্রিত থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অন্যের সন্তানকে বিনা বেতনে পড়িয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন লোকমান আলী।
মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মাঝে মধ্যে না খেয়ে থাকতো লোকমান আলী। সাহায্যের জন্য সরকারি সহায়তা পাঠালে তিনি না নিয়ে পাশের দুস্থ প্রতিবেশিকে দিতে দেন। এমন স্বার্থহীন ও সাদা মনের মানুষ সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯
এনটি