রাস্তায় নেমেছিলেন লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিওসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক শহরে বসবাসকারীরাও। হেডলাইন, লাইভ আর টকশোতে ঝড় তুলেছে দেশের গণমাধ্যমগুলো।
বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের কেমন রায় হওয়া উচিত- এ ব্যাপারে বাংলানিউজ কথা বলে নুসরাতের পরিবার, প্রতিবেশী, সহপাঠীসহ স্বজনদের সঙ্গে। কথা হয় আইনজীবী ও বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে। আর তাতে সবার একটাই দাবি উঠে আসে, রায় যেন সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। এ রায়টি দেখে যেন অপরাধীরা অপরাধ থেকে দূরে সরে আশার শিক্ষা নিতে পারে।
রায়ের আগের দিন সোনাগাজী পৌর শহরের অদূরে নুসরাতের বাড়ির মূল ফটক পেরোতেই চোখে পড়ে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা বসে আছেন। কাছে গিয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে। কর্তব্যরত ওই তিনি পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে এ বাড়ি পাহারার দায়িত্বে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে নুসরাতের বাড়ির উঠানে পা রাখতেই যেন শরীর হিম হয়ে আসে- পুরো বাড়িতে সুনসান নিরবতা, কোনো সাড়া শব্দ নেই।
ঘরে ঢুকে পা রাখতেই চোক পড়ে খাটে শুয়ে থাকা নুসরাতের দাদা মাওলানা মোশারফের দিকে। বার্ধ্যকের কারণে তিনি চোখে দেখেন না। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলেন, চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। তিনি বলেন, ‘বাবারে আমিতো চোখে দেখি না, নাতিনটা আমার চোখের আলো ছিলো, আমার নাতিনটারে কেন ওরা খুন করলো’?
খুনিদের বিচারের ব্যাপারে দাদা মোশারফ বলেন, দুনিয়ার বিচাররকের কাঠগড়ায় তাদের বিচার কি হবে জানি না, তবে আল্লাহ তাদের বিচার করবেন। আল্লাহর কাছে বিচার চাইলাম-খুনিরা যেন জাহান্নামের আগুনে পোড়ে, আমার নাতিন আগুনে পুড়ে যেমন কষ্ট পেয়েছে তারা চেয়ে হাজারগুন কষ্ট যেন তারা পায়।
খানিক পরে সামনে এলেন নুসরাতের মা শিরিন আখতার। মেয়ের শোকে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছিল তার। মেয়ের খুনিদের বিচারের রায়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার মেয়ে যেভাবে পোড়ার যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছে, ঠিক তেমন যন্ত্রণা দিয়ে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক, আমার মেয়ে হত্যার রায় যেন সারা বিশ্বের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
নুসরাতের বড় ভাই ও মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বোনটি ছিলো আমাদের তিন ভাইয়ের কলিজার টুকরা, বোনকে হারিয়ে আজ আমরা নিঃস্ব, আমরা আমাদের বোনের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নোমান বলেন, ‘তিনি আন্তরিক না হলে এত দ্রুত এ হত্যার বিচার হত না। আমরা তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।
নুসরাতের মাদ্রাসা সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় গিয়ে কথা হয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা হোসাইন আহম্মদের সঙ্গে। তিনি বলেন, নুসরাত হত্যার মাধ্যমে আমাদের মাদ্রাসাও কলঙ্কিত হয়েছে, খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে সেই কলঙ্কের কিছুটা হলেও মোচন হবে।
নব নির্বাচিত মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির পরিচালক ব্যবসায়ী মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই’।
কথা হয় নুসরাতের বান্ধবী নিশাত সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিগত চয় মাস ঠিকমত ঘুমাতে পারি না, চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে নুসরাতের চেহারা। নিশাত বলেন, খুনি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ নুসরাতকে শুধু একবার মারেনি, মরার আগেও বারবার মেরেছে। সিরাজসহ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন নুসরাতের এই বান্ধবী।
সোনাগাজী পৌর শহরের আল হেলাল একাডেমির পাশে নুসরাতের কবরে গিয়ে দেখা যায়, কবেরর চারপাশের বাঁশের বেড়াগুলো এখনো অক্ষত আছে, শ্রদ্ধাঞ্জলীর ফুলগুলোও রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) নৃশংস সেই হত্যার মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) দুপুরে রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের এ তারিখ ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক মো. মামুনুর রশিদ।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা।
৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আট জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; যা মৃত্যুশয্যায় নুসরাত বলে গেছেন। ১০ এপ্রিল ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।
২৮ মে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিআইবি) কর্মকর্তারা। সেদিন অভিযোগপত্রসহ মামলার নথি বিচারক ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে পাঠিয়ে দেন। এরপর ৩০ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আসামিদের হাজির করা হলেও বিচারক সেদিন অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি না করে ১০ জুন শুনানির তারিখ ধার্য করেন।
পরে ১০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগপত্রের ১৬ আসামি হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল। মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে পিবিআই। আদালত তা অনুমোদন করেন। তারা হলেন- নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও শাহিদুল ইসলাম।
মামলার চার্জশিট জমা দেওয়ার আগে ৭ জন সাক্ষী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় গ্রেপ্তার মাদ্রাসারা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এছাড়া যৌন হয়রানির মামলার পর নুসরাতের জবানবন্দি গ্রহণের সময় তার ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে সাইবার আইনে মামলা হওয়ার পর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
এসএইচডি/জেডএস