ঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৭ মার্চ। ওইদিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে একটি মামলা করেছিলেন নিহত নুসরাতের মা শিরিন আখতার।
কারাগারে থাকা অবস্থায় ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে পরামর্শ করে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়।
ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে তার অবস্থার অবনতি হলে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা চলে নুসরাতের।
এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনকে আসামি করে ও অজ্ঞাতপরিচয় বোরকা পরা চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ১০ এপ্রিল মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয়। সেদিন রাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নুসরাত। মৃত্যুর আগে ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ দিয়ে যায় সে। তার সেই ডিক্লারেশনের ক্লু-ধরেই এগুতে থাকে মামলাটি। এক করে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।
১১ এপ্রিল নুসরাতের মরদেহ আনা হয় তার বাড়িতে। সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে তার নামাজে জানাজার পর অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে সমাহিত করা হয়। নুসরাতের জানাজাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিল। এরপর একে একে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ১২ জন। ২৮ মে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালত ৫ জনকে বাদ দিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ জনকে। নুসরাত হত্যায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে। থানায় হেনস্তা হওয়ার নুসরাতের ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই উপ-পরিদর্শককে (এসআই) বহিষ্কার করা হয় ৮ মে। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়, ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন। দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিতর্ক। চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবরকে নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক গ্রহণ করা হয়।
সাক্ষীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও পিবিআইয়ের তদন্তে প্রতীয়মান হয় ছাদে কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৫ জন। কারাগার থেকে হত্যার নির্দেশ দেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ্য সিরাজ উদ-দৌলা। আর অর্থ যোগানদাতা ছিলেন তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রহুল আমীন ও কাউন্সিলর মাকসুদ। গেট ও সিঁড়ি পাহারায় ছিল বাকি আসামিরা।
মামলার এজহারনামীয় আসামিরা হলেন (এজহার তালিকা অনুযায়ী):
১. সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা।
২. নুর উদ্দিন, সাবেক ছাত্র।
৩. শাহাদাত হোসেন শামীম, ছাত্রলীগ নেতা ও মাদ্রাসাছাত্র, ফাজিল।
৪. মাকসুদ আলম, কাউন্সিলর, ৪ নং ওয়ার্ড, সোনাগাজী পৌরসভা।
৫. জোবায়ের আহম্মেদ, সদস্য, অধ্যক্ষ মুক্তি পরিষদ।
৬. জাবেদ হোসেন, মাদ্রাসাছাত্র।
৭. হাফেজ আবদুল কাদের, হেফজখানার শিক্ষক।
৮. আফসার উদ্দিন, প্রভাষক, ইংরেজী।
এজহারনামীয় গ্রেফতার:
১. এস এম সিরাজ উদ-দৌলা, অধ্যক্ষ রিমান্ড-৭ দিন-আদালতে ১৬৪।
২ আফসার উদ্দিন, প্রভাষক- রিমান্ড-৫ দিন।
৩.জোবায়ের আহম্মেদ- রিমান্ড-৫ দিন-১৬৪ স্বীকারোক্তিমূলক।
৪. মাকসুদ আলম, কাউন্সিলর, রিমান্ড-৫ দিন।
৫. জাবেদ হোসেন- রিমান্ড-৭ দিন, দ্বিতীয় দফা ৩ দিন। ১৬৪ স্বীকারোক্তিমূলক।
৬. নুর উদ্দিন- ১৬৪ ধারা জবানবন্দি।
৭. শাহাদাত হোসেন শামীম-১৬৪ ধারা জবানবন্দি, ২৫ এপ্রিল ৩ দিনের রিমান্ড।
৮. হাফেজ আবদুল কাদের-১৬৪ ধারা জবানবন্দি।
আসামি ও রিমান্ড:
৯. আরিফুল ইসলাম- রিমান্ড-৫ দিন।
১০. সাইদুল ইসলাম- রিমান্ড-৫ দিন।
১১. কেফায়েত উল্লাহ- রিমান্ড-৫ দিন।
১২. নুর হোসেন- রিমান্ড-৫ দিন।
১৩. আলা উদ্দিন- রিমান্ড-৫ দিন।
১৪. উম্মে সুলতানা পপি- রিমান্ড-৫ দিন।
১৫. মো. শামীম-১৫ এপ্রিল গ্রেফতার- ১৮ তারিখ শুনানি।
১৬. কামরুন নাহার মনি-১৫ এপ্রিল গ্রেফতার, ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর।
১৭. আবদুর রহীম শরিফ- ১৭ এপ্রিল গ্রেফতার এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি।
১৮. রহুল আমিন, সভাপতি, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ। গ্রেফতার ২০ এপ্রিল, রিমান্ড-৫ দিন।
১৯. এমরান হোসেন মামুন সরাসরি কারাগারে।
২০. ইফতেখার উদ্দিন রানা। সরাসরি কারাগারে।
২১. মহিউদ্দিন শাকিল, গ্রেফতার ২৫ এপ্রিল, ফেনীর উকিলপাড়া থেকে।
আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ১২ জন:
১. নুর উদ্দিন- (এজহারনামীয়)।
২. শাহাদাত হোসেন শামীম- (এজহারনামীয়)।
৩.আবদুর রহিম শরিফ-(এজহারনামীয়)।
৪. হাফেজ আবদুল কাদের-(এজহারনামীয়)।
৫. উম্মে সুলতানা পপি- (সন্দিগ্ধ)।
৬. জাবেদ হোসেন- (এজহারনামীয়)।
৭. কামরুন নাহার মনি (সন্দিগ্ধ)।
৮. জোবায়ের আহম্মেদ (এজহারনামীয়)।
৯. অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা। (এজহারনামীয়)।
১০. এমরান হোসেন মামুন।
১১. ইফতেখার উদ্দিন রানা।
১২. মহিউদ্দিন শাকিল, গ্রেফতার ২৫ এপ্রিল, ফেনীর উকিলপাড়া থেকে।
ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের অপরাধ:
১. মামলার কালক্ষেপণ।
২. এজহার নিয়ে কূটচাল।
৩. গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ।
৪. নুসরাতকে থানায় জবানবন্দির নামে ওসির হেনস্তা।
৫. আইনি বহির্ভূত জিজ্ঞাসাবাদ।
৬. প্রথমে অজ্ঞাত মামলা, পরে ৮ জনের নামোল্লেখ।
কিলিং মিশনে যে পাঁচজন অংশ নিয়েছিল:
১ শাহাদাত হোসেন শামীম।
২ জাবেদ হোসেন।
৩ জোবায়ের আহম্মদ।
৪ উম্মে সুলতানা পপি।
৫ কামরুন নাহার মনি।
চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলেন:
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহ সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
যারা ১৬৪ ধারা জবানবন্দি দেননি, তারা হলেন:
মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর।
আবছার উদ্দিন, রুহুল আমিন, মোহাম্মদ শামীম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
এসএইচডি/এএটি