চাঁপাইনবাবগঞ্জ: দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর অবশেষে পুনঃসংস্কারের পর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একমাত্র পর্যটন মোটেল সোনামসজিদ। চলতি মাসেই এর উদ্বোধনের কথা রয়েছে।
২০১৩ সালের ৩ মার্চ উদ্বোধন হবার কথা ছিল মোটেলটি। কিন্তু উদ্বোধনের কয়েকদিন আগেই ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিন জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের দেওয়া আগুন ও ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সোনামসজিদ পর্যটন মোটেল।
একই দিন নিহত হন পর্যটন বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলীও। মোটেলটির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় আর চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে নানা জটিলতার পর অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রায় সাড়ে ৭ বছর পর সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে মোটেলটির। প্রতিক্ষার প্রহর শেষে চলতি মাসের শেষের দিকেই এটি উদ্বোধন করা হতে পারে। এটি চালু হলে বাড়বে এখানকার পর্যটক।
জানা যায়, মুসলিম স্থাপত্য শিল্পে সমৃদ্ধ বাংলার পুরাতন রাজধানী গৌড়ে বিপুল সম্ভবনা থাকা সত্বেও সোনামসজিদে পর্যটনের ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শিবগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর মৌজায় মোটেল নির্মাণের জন্য পর্যটন করপোরেশনের নামে এক একর জমি অধিগ্রহণ করে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সোনামসজিদে পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য এটির জন্য অর্থ বরাদ্দ দেন।
তিন তলা বিশিষ্ট পর্যটন মোটেলটিতে রয়েছে ১৮টি ভিআইপি কক্ষ, ১২টি সাধারণ কক্ষ, ইকোনমি কক্ষ ও সাধারণের জন্য ১২টি ডরমিটরি কক্ষ এবং একটি করে অভ্যর্থনা কক্ষ, ক্যান্টিন, রান্নাঘর, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের ব্যবস্থা রয়েছে।
এদিকে, এ গৌড়ে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও মেজর নাজমুল হকের সমাধি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবর, ঐতিহাসিক তাহখানা, কামেল পীর হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহের (র.) মাজার, ছোট সোনামসজিদ, শাহ সুজার প্রাসাদ, দারাসবাড়ি মসজিদ, মাদ্রাসা, কোতোয়াল দিঘি, টাকশাল দিঘি, দখলদরজা, চামাকাঠি মসজিদ, ধনাইচক মসজিদ, খঞ্জনদিঘির মসজিদসহ অসংখ্য পীর আউলিয়াদের মাজার। বিশাল এক দিঘি যার নাম বালিয়াদিঘি। এছাড়া এ সুপ্রাচীন স্থাপত্য দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন। প্রতিদিন এ এলাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখার জন্য দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক এখানে আসেন। সোনামসজিদে রয়েছে দেশের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর, কাস্টমস ইমিগ্রেশন অফিস। এখান দিয়ে প্রতিদিন পাসপোর্টের মাধ্যমে ভারত যাতায়াত করে থাকেন দু’দেশের নাগরিকরা।
মূলত পর্যটন কেন্দ্রিক সোনামসজিদ এলাকা হওয়ায় এবং ভারতে যাতায়াতের ইমিগ্রেশন ও স্থলবন্দর থাকায় ওই এলাকায় একটি পর্যটন মোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. এনামুল হক মোটেলটির কাজ দ্রুত শেষ করে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ উদ্ধোধনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু এর মাত্র দু’দিন আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে মোটেলটি। অর্থ বরাদ্দে বিলম্ব এবং বিভিন্ন জটিলতায় দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত পড়ে থাকে এটি।
পরবর্তীতে মোটেলটি সংস্কার করে চালু করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জাহিদুল ইসলাম। এর পরেও পর্যটন মোটেলটি চালু করার উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এর প্রায় ৫ বছর পর এটি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয় বেসামরিক ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
সোনামসজিদ ঘুরতে আসা কিবরিয়া মিজান বাংলানিউজকে বলেন, এর আগেও এখানে ঘুরতে এসেছি। এখানে সব থেকে বড় সমস্যা থাকার। প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় রাত যাপনের জন্য থাকার ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অনেকগুলো পর্যটন কেন্দ্র থাকায় এখানে একদিনে ঘুরাও শেষ হয় না। খাবার হোটেলেরও সমস্যা রয়েছে এখানে। পর্যটন মোটেল চালু হলে এটি আর থাকবে না বলে আমরা আশা করছি।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের সব কাজ শেষ হয়েছে। ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে সোনামসজিদ মোটেলটির সংস্কার করা হয়েছে। এটি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি এটি দৃষ্টি নন্দন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগুনে আমাদের প্রায় সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছিল। এগুলোকে আবারও নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের সব ফার্নিচার ও আনুসঙ্গিক জিনিসও কেনা হয়েছে। এরই মধ্যে এখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) এসেছেন। চলতি মাসের শেষ দিকে বা যে কোনো দিনই এটি উদ্বোধন করা হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, শিবগঞ্জ ইউএনও সাকিব-আল-রাব্বি বাংলানিউজকে বলেন, সোনামসজিদ মোটেলটির সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই চালু করা হবে। এটি চালু হলে পর্যটক আরও বাড়বে। এছাড়াও পর্যটকদের থাকার পাশাপশি ভালো মানের খাবার ব্যবস্থাও করা যাবে। এছাড়াও আমাদের কিছু পর্যটন কেন্দ্রের সংযোগ সড়ক নেই। সেগুলো করার জন্য বাজেট চাওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী বছরেই এগুলো শেষ করা যাবে। তখন আরও পর্যটক প্রিয় হয়ে উঠবে এই গৌড় শহর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ জেড এম নূরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, চলতি মাসের শেষের দিকেই মোটেলটির কার্যক্রম শুরু হবে। এর মধ্য দিয়ে জেলার পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মোটেলের তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পারিসা কনস্ট্রাকশন প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মোটেলটি নির্মাণ করে। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর এটি পর্যটন করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০২০
এসআরএস