লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে গণপিটুনিতে শহীদুন্নবী জুয়েলকে হত্যা ও মরদেহ পোড়ানোর অভিযোগে করা তিন মামলায় দ্বিতীয় ধাপে গ্রেফতার মসজিদের খাদেমসহ পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে জেলহাজতে ও এক কিশোরকে যশোর কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সোমবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় আমলি আদালত-৩ এর বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌসী বেগম এ আদেশ দেন।
দ্বিতীয় ধাপে গ্রেফতার করা পাটগ্রাম ইউনিয়নের রহমানপুর গ্রামের বাসিন্দা ও বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খাদেম জোবেদ আলী (৬১), বুড়িমারী ইউনিয়নের কামারেরহাট এলাকার জাহেদুল ইসলামের ছেলে মেহেদী হাসান রাজু (১৯), নামাজিটারী গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৫৫) এবং উফারমারা তেলিপাড়া গ্রামের সহিদার রহমানের ছেলে মনিরুজ্জামান মানিককে (২৬) লালমনিরহাট জেলহাজতে এবং নামাজিটারী গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে মেরাজুল ইসলাম নেইমারকে (১৭) যশোর কিশোর সংশোধনাগারে (শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র) পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
ঘটনার পর থেকে প্রথম দফায় পাঁচজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে রোববার (১ নভেম্বর) আদালতে নিয়ে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত মঙ্গলবার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর সোমবার (২ নভেম্বর) মসজিদের খাদেমসহ আরো পাঁচজনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত তাদের মধ্যে চার আসামিকে জেলহাজতে এবং এক কিশোরকে যশোর কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় দুই দফায় খাদেমসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
প্রথম দফায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ওই এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছেলে আশরাফুল আলম (২২) ও বায়েজিদ (২৪), ইউসুব আলী ওরফে অলি হোসেনের ছেলে রফিক (২০), আবুল হাসেমের ছেলে মাসুম আলী (৩৫) এবং সামছিজুল হকের ছেলে শফিকুল ইসলাম (২৫)। এ পাঁচজনের পাঁচদিনের রিমান্ড শুনানির দিন মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) ধার্য করেন আদালত।
কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার অভিযোগে নিহতের চাচাত ভাই সাইফুল ইসলাম বাদি হয়ে শনিবার (৩১ অক্টোবর) একটি মামলা অভিযোগের করেন। একই ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে পাটগ্রাম থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী বাদি হয়ে এবং ইউনিয়ন পরিষদ ভাঙচুরের অভিযোগে অপর একটি মামলা অভিযোগের করেন বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত। বহুল আলোচিত তিনটি মামলায় জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হারিয়ে ফেলেন তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল বৃহস্পতিবার বিকেলে সুলতান যোবাইয়ের আব্দার নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা।
নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে পড়ে যায়। এ সময় কোরআর ও হাদিস বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান যোবাইয়েরকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।
সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্থানীয়রা। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ।
ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম এ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২০
এসআই