লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে গণপিটুনি দিয়ে শহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর (৪৫) রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
শনিবার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে আমলী আদালত-২ এর বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আফাজ উদ্দিনের আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
এর আগে সোমবার (৯ নভেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে আমলী আদালত-৩ এর বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌসী বেগম আবুল হোসেনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত শনিবার (৭ নভেম্বর) সকালে আলোচিত এ ঘটনায় করা তিন মামলার প্রধান আসামি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটরকে ঢাকা কুড়িলা বিশ্বরোড থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা।
একইসঙ্গে বুড়িমারী ইসলামপুরের ফাহিম উদ্দিনের ছেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিনকে (৫২) গ্রেফতার দেখিয়ে শনিবার (১৪ নভেম্বর) আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। এসময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক মাহমুদুন্নবী। আমলী আদালত-৩ এর বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌসী বেগম রোববার (১৫ নভেম্বর) শুনানির দিন ধার্য করে মুয়াজ্জিনকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এ নিয়ে আলোচিত তিন মামলায় মোট গ্রেফতার হলেন ৩২ জন। এ মামলায় এর আগে ১০ জনকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। যার মধ্যে প্রধান আসামি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর ও মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ চার জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কোরআন অবমাননা হয়নি উল্লেখ করে জবানবন্দিতে তারা ব্যাপক তথ্য দিয়েছেন। যা নিয়ে মামলার পরবর্তী তদন্ত চলছে বলেও জানায় পুলিশ।
হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুন্নবী বাংলানিউজকে জানান, আলোচিত এ মামলার প্রায় ৭৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। মসজিদে এবং ইউনিয়ন পরিষদে পিটিয়ে হত্যা পর্যন্ত কারা জড়িত ও কতটুকু অভিযুক্ত তা নিরুপণ করা সম্ভব হয়েছে। যার বেশ কিছু আসামি গ্রেফতার রয়েছে। বাকিদেরও ভিডিও ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে জুয়েলের মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাটি পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। আসামিদের রিমান্ড ও ভিডিও ফুটেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই বাচাই চলছে। পথচারী বা উৎসুক নিরপরাধ ব্যক্তি যেন ফেঁসে না যায়। তা গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
হত্যা মামলার প্রধান আসামি আবুল হোসেন পাঁচ দিনের রিমান্ডে তদন্ত কর্মকর্তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। যার তদন্ত চলছে। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত জুয়েল কোরআনে পা রাখেননি। তবে কোরআন রাখা সেল্ফের ফ্লোরে পা দিয়ে উপরের ফেল্ফের বই খুঁজছিলেন। পরে তাকে প্রশ্ন করলে কখনো নিজেকে ডিবি, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা পরিচয় দিচ্ছিলেন জুয়েল। জুয়েলের মানসিক বিকারগ্রস্ত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকটি চড়থাপ্পর দিয়ে ইউপি সদস্যের হাতে জুয়েলকে তুলে দেন বলেও স্বীকার করেন গ্রেফতার প্রধান আসামি আবুল হোসেন। ইউপি ভবনের জনবিস্ফোরণ থামাতে তার প্রতিষ্ঠানের মাইক ব্যবহার করে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ কর্মকর্তারা কথা বলেন। তখন তিনি মাইক পাঠিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসেছিলেন বলেও দাবি করেন আবুল হোসেন। তবে এ ঘটনায় প্রধান আসামি আবুল হোসেন অনুতপ্ত বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তা।
পাঁচ দিনের রিমান্ডে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শনিবার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে তাকে আদালতে হাজির করেন রিমান্ড গ্রহণকারী মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এ সময় আবুল হোসেন আদালতকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল ২৯ অক্টোবর বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন (৫১) নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা।
নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে পড়ে যায়। এ সময় কোরআন ও হাদিসের বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।
সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী রুবায়াত সুমনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম এ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৩২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পাননি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২০
আরএ