লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে গণপিটুনি দিয়ে শহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার বুড়িমারী জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিনের (৫৫) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রোববার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে আমলি আদালত-৩ এর বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌসী বেগম রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।
মুয়াজ্জিন আফিজ লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ইসলামপুর এলাকার ফইমুদ্দিনের ছেলে। তিনি বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন।
এর আগে শনিবার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে মুয়াজ্জিনকে আদালতে সোপর্দ করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুন্নবী। রোববার শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত।
রোববার দুপুরে আমলি আদালত-৩ এ আসামি আফিজকে হাজির করে পুলিশ। এ সময় রিমান্ড আবেদন শুনানি শেষে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ নিয়ে এ ঘটনায় ১১ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরই মধ্যে মুলহোতা বুড়িমারী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর এবং মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এ দিকে এ ঘটনায় রোববার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে বুড়িমারী উফারমারা গুড়িয়াটারী গ্রামের মফিজ উদ্দিনের ছেলে হেলাল উদ্দিনকে (৩২) গ্রেফতার করে পুলিশ। এ নিয়ে এ ঘটনায় মোট ৩৪ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। সর্বশেষ গ্রেফতার হেলাল পুলিশের ওপর হামলা ও হত্যা মামলার এজাহার নামীয় আসামি। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে বলে বাংলানিউজকে জানান লালমনিরহাট জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক।
এর আগে গত ২৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার ) বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল বৃহস্পতিবার বিকেলে যোবাইয়ের আব্দার নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে ওপর পড়ে যায়। সে সময় কোরআর ও হাদিস বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।
সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। সে সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্থানীয়রা। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাটের ডিসি আবু জাফর ও এসপি আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন।
এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পাননি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।
* পুড়িয়ে হত্যা: মূলহোতা শ্রমিক লীগ নেতা হোসেন ৫ দিন রিমান্ডে
* বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননা হয়নি
* পুড়িয়ে হত্যা: মূলহোতা শ্রমিক লীগ নেতার স্বীকারোক্তি
* পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় খাদেমসহ ৩ জনের দায় স্বীকার
* বুড়িমারীতে মসজিদের খাদেমসহ আরও ৪ জন ৩ দিনের রিমান্ডে
* বুড়িমারীতে গ্রেফতার আরও ৫, বৃহস্পতিবার ৪ জনের রিমান্ড শুনানি
* গুজব ছড়িয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটি
* গুজব ছড়িয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা: আলেমদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠক
* বুড়িমারীর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চাইলেন পাঁচ শতাধিক আলেম
* লালমনিরহাটে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩ মামলা, গ্রেফতার ৫
* বুড়িমারীতে মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দল
* বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার সত্যতা পায়নি মানবাধিকার কমিশন
* বুড়িমারীর ঘটনায় গ্রেফতার করা ৫ জনের রিমান্ড শুনানি সোমবার
* বুড়িমারী মসজিদের খাদেমসহ আরও ৫ জন গ্রেফতার
* বুড়িমারীতে গ্রেফতার ৫ জনের রিমান্ড শুনানি পিছিয়ে মঙ্গলবার
* বুড়িমারীতে খাদেমসহ গ্রেফতার ৫ জন জেলহাজতে
* হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন জুয়েলের সঙ্গী সুমন
* জব ছড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ৫ আসামির তিন দিনের রিমান্ড
* গুজব ছড়িয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, মৃতদেহে আগুন
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২০
এসআরএস