ঢাকা, সোমবার, ৫ কার্তিক ১৪৩১, ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নিত্য বঞ্চনার শিকার ফেনী নদী পাড়ের জেলেরা 

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০২১
নিত্য বঞ্চনার শিকার ফেনী নদী পাড়ের জেলেরা  নিত্য বঞ্চনার শিকার ফেনী নদী পাড়ের জেলেরা 

ফেনী:  ছোট ও বড় ফেনী নদীর মোহনায় ভিন্ন জেলা থেকে আসা জেলেদের অবাধে জাটকা নিধনের ফলে মাছ পাচ্ছেন না ফেনীর জেলেরা। প্রতিবাদ করতে গেলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, উল্টো জরিমানা গুনতে হয়, এমনকি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ আড়তে মাছ বিক্রি করতে হয় পানির দরে।

এমন অভিযোগ করেছেন সোনাগাজীর চর চান্দিয়া ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকার জেলেরা।

ফেনী উপকূলে পাইকারি মাছ বিক্রয়ের কোনো ঘাট (ল্যান্ডিং স্টেশন) না থাকা, সমস্যা সমাধানে অভিভাবক না পাওয়া এবং আহরিত মাছ ফেনীতে বাজারজাত করতে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকাকে নিজেদের জিম্মি দশার কারণ এবং প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় জেলেরা।

বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ল্যান্ডিং স্টেশনের প্রস্তাবনা থাকলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি বা পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয় বলে জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি ফেনীর উপকূলের জেলেরা।

উপকূলীয় এই এলাকায় কথা হয় জেলেদের সঙ্গে। জেলে পাড়ার সর্দার কৃষ্ণবর্ধন ও মো. শফিউল্লাহ ছুট্টু মহাজন জানান, ছোট ও বড় ফেনী নদীর মোহনায় বরিশাল, ভোলা, রামগতি ও নোয়াখালী অঞ্চলের জেলেরা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে দেড়শ থেকে আড়াইশ গ্রাম ওজনের জাটকা নিধন করছে।

আলী আফসার নামে অপর এক জেলে জানান, তাদের ব্যবহৃত জালগুলো দুই ইঞ্চি ফাঁক বিশিষ্ট এবং জালগুলো নদীর তলদেশ থেকে উপরের দিকে খাড়াভাবে ঝুলিয়ে রাখে। ফলে মাছ তাদের জালে ধরা পড়ছে। এ কারণে সাগর থেকে মোহনা পার হয়ে ফেনী নদীতে বিশেষত ইলিশ মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

নুর আলম নামে আরেকজন জেলে বলেন, আমাদের ব্যবহৃত জালগুলো সাড়ে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি ফাঁক বিশিষ্ট। জালগুলো যখন মোহনা দিয়ে ভাসানো হয় মাঝে মাঝে কারেন্ট জালে আটকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জেলেরা। অথচ এতে আমাদের অপরাধ না থাকলেও দোষ আমাদের ঘাড়েই পড়ে। বাড়াবাড়ি করলে নদীতেই শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এবং কোম্পানীগঞ্জে মাছ আড়তে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে বিচার হয়।

এ প্রসঙ্গে জেলে আলী আফসার জানান, মাস তিনেক আগে এমন একটি ঘটনায় তিনিসহ ফেনীর দুই জেলেকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয় এবং হুমকি ধমকি হজম করতে হয়।

হরমোহন দাস জানান, ফেনী উপকূলে জাটকা নিধন বন্ধে মৎস্য বিভাগ ও পুলিশের তৎপরতা থাকলেও নদীর মোহনার দিকে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি অনুপস্থিত। ফলে জাটকা নিধন দিন দিন বাড়ছে।

জেলেদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ফেনীর জেলেদের ওপর মানসিক নির্যাতনের এমন খবর আগে পাইনি। ফেনী নদীর মোহনা জেলার অন্তর্গত নয়। তবে জাটকা নিধনের অভিযোগের বিষয়টি নোয়াখালী মৎস্য বিভাগকে অবহিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘাট (ল্যান্ডিং স্টেশন) স্থাপন প্রসঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তা জানান, সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের অবহিতকরণ সভায় ল্যান্ডিং স্টেশন স্থাপনের বিষয়ে আমরা প্রস্তাব করেছি। এটি হলে জেলেরা মাছের ন্যায্য দাম পাবেন।

জেলে পাড়ায় ৮৫টি পরিবার বাস করে বলে জানান কৃষ্ণধন সর্দার। মোট সদস্য সংখ্যা সাড়ে ৫ শতাধিক। তিনি জানান, মাছ ধরার বড় ইঞ্জিন নৌকা রয়েছে ১০টি। এছাড়া ছোট নৌকা রয়েছে ৭০টি।

ফেনীর জেলেদের মাছ ধরার সরঞ্জাম ও সামর্থ্য প্রসঙ্গে নুর আলম জানান, এখানকার জেলেরা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। বড় কোনো মাছ ধরার নৌকা নেই। ফলে ফেনী নদীর মোহনা এবং নদী এলাকাতে মূলত মাছ আহরণ করে থাকেন। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সুযোগ থাকলেও সামর্থ্য না থাকার কারণে তা সম্ভব হয় না।

মাছ আহরণের পরিমাণ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আলী আফসার জানান, দুই বছর আগেও বড় নৌকাগুলোতে প্রতিবার বর্ষার মৌসুমে ১০ লাখ টাকারও বেশি মাছ ধরা যেত। গত বছর তা তিন লাখ টাকায় নেমে আসে। এতে মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয়ও নির্বাহ সম্ভব হয় না। তাই আমি আমার সব নৌকা বেঁচে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।

জাটকা ধরা বন্ধ করা না গেলে ফেনী অঞ্চলের জেলেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে এমন আশঙ্কা করেছেন প্রিয়লাল সর্দার ও ছুট্টু মহাজন।

ইতোপূর্বে সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার দায়িত্বে সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার পাল জানান, উপজেলায় ১ হাজার ৬২৪ জন জেলের তালিকা রয়েছে। ইলিশ মাছ ধরেন এমন জেলের সংখ্যা ২৫০ জন। সোনাগাজী উপকূলে প্রাপ্ত ইলিশ মাছের ওজন সাধারণত ৬শ থেকে ৮শ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ উপকূলে আহরণকৃত ইলিশের পরিমাণ ৭৯ দশমিক ২৮ টন।

ফেনী উপকূলে আহরিত জেলেদের মাছের প্রধান বাজার হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জ আড়ত। জেলেরা অভিযোগ করেন, মূলত এই আড়তদারদের অর্থায়নে এবং পেশী শক্তির কারণেই জাটকা নিধনের ঘটনাটি ঘটছে এবং ফেনী অঞ্চলের জেলেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আহরিত মাছ ফেনীর বাজারে আনার সহজ উপায় না থাকায় নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম জেলা উপকূলীয় ঘাটে মাছ বেঁচতে হয়।

ফেনীর জেলেদের উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের উপায় প্রসঙ্গে জেলে আলী আফসার বলেন, উপকূল অঞ্চলে ঘাট (ল্যান্ডিং স্টেশন) এর বিকল্প নেই। ঘাট থাকলে সব জেলে ঘাটে বসেই পাইকারি দরে মাছ বিক্রি করতে পারত।

তিনি আরও বলেন, ঘাট এখনই না হলেও একই ইউনিয়নের জিন্নাত আলী মসজিদ থেকে দক্ষিণে আবুল্যার চর পর্যন্ত সড়কটি যোগাযোগের উপযোগী করে দিলেও আহরিত মাছ ফেনীতে সরবরাহ সম্ভব হত।

জেলেদের সমস্যা প্রসঙ্গে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন জানান, বিশ্ব ব্যাংকের প্রকল্পটিতে ল্যান্ডিং স্টেশন ছাড়াও উপকূলেই একটি কোল্ড স্টোরেজ করার ব্যাপারে প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলেদের আহরিত মাছ যাতে পচে না যায় এবং পানির দরে বেঁচতে না হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০২১
এসএইচডি/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।