ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বুড়িমারীতে পুড়িয়ে হত্যা: আরও একজন গ্রেফতার

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২১
বুড়িমারীতে পুড়িয়ে হত্যা: আরও একজন গ্রেফতার

লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় শরিফুল ইসলাম (৩৯) নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৯ জনকে গ্রেফতার করা হলো।

মঙ্গলবার (২৯ জুন) দিনগত রাতে পাটগ্রাম উপজেলা সদর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার শরিফুল ইসলাম আদিতমারী উপজেলার পশ্চিম ভেলাবাড়ি গ্রামের মৃত ওসমান আলীর ছেলে। তিনি পাটগ্রামের ধবলসুতি মসজিদের ইমাম।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবু হাসান কবির বাংলানিউজকে বলেন, আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল হত্যায় দায়ের করা হত্যা মামলা, পুলিশের ওপর হামলা ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনে হামলার মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে মঙ্গলবার রাতে শরিফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।

তদন্তে হত্যা ও মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গ্রেফতার শরিফুল ইসলাম ঘটনার এক সপ্তাহ আগে চাকরির সুবাদে পাটগ্রামে যান। অল্প সময় বুড়িমারীতে অবস্থান করায় ওই এলাকার কাউকে তিনি চেনেন না। ফলে প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি শরিফুল। তবে ব্যাপক জিজ্ঞসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে করা হবে বলেও জানান তিনি।  

জুয়েল হত্যার ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ৪৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ১৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। যার মধ্যে মূলহোতা বুড়িমারী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর এবং মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ ছয় জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই মামলায় গ্রেফতারদের মধ্যে হত্যা মামলায় মুয়াজ্জিন ও অন্য দুই মামলায় মোট ছয় জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলেও বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিরুল ইসলাম।

জানা যায়, গত ২৯ অক্টোবর বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র ছিলেন। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, সাহিদুন্নবী জুয়েল ২৯ অক্টোবর বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তার পায়ের ওপর পড়ে যায়। সে সময় কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশের ইউপি ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।  

সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। সে সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউপি ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে-হিঁচড়ে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।

সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট-পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার তৎকালিন ওসি সুমন কুমার মহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।  

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন দু’টি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

**বুড়িমারীতে পুড়িয়ে হত্যা, ইউপি সদস্য গ্রেফতার

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২১
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।