ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে!

সোলায়মান হাজারী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০২১
স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে!

লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী থেকে ফিরে: লক্ষ্মীপুরে চর আলেকজেন্ডার মেঘনা নদীর তীর রক্ষা বাঁধের ওপর চা-সিগারেট, চকলেট-বিস্কুটসহ বিভিন্ন পানীয় বিক্রি করছিল কিশোর রায়হান। কথা বলে জানা গেল স্থানীয় একটি স্কুলের ৫ম শ্রেণিতে পড়তো সে।

করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় বাবা তাকে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছেন। তার উপার্জনের টাকা খরচ হয় তাদের সংসারে। লেখাপড়া ছেড়ে রায়হান এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। কখনো স্কুলে ফিরবে কিনা তা অনিশ্চিত।
 
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রমনী ইউনিয়নের চর আলী হাসান গ্রামের আবদুল আহাদ। স্থানীয় ডা. আবদুল হক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। স্কুল বন্ধ থাকায় এখন সে চা দোকানী।  

আহাদের বাবা শাহ আলম জানান, স্কুল বন্ধ পড়ালেখা নাই তাই চা দোকান দিয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।  

একই স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র অন্তর হোসাইন বলে, তাদের ক্লাসে ৬৩ জন শিক্ষার্থী ছিল। এখন ২৫ জনও নেই। স্কুলের সঙ্গে কোন ধরনের যোগাযোগও নেই অধিকাংশের।

একই চিত্র নোয়াখালীর উপজেলা হাতিয়াতেও। উপজেলার নলছিরা ছিদ্দিকীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুজন ও হাসানকে দেখা গেলো ভাঙ্গাড়ির ব্যবসা করতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরাতন জিনিসপত্র কিনে উপজেলা সদরের ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করে দিনে এক থেকে দেড়শ টাকা আয় হয় তাই তুলে দেয় মায়ের হাতে। শিশু শ্রমের এমন চিত্র দেখা গেছে ফেনীতেও।

দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় লেখাপড়া ছেড়ে বিভিন্ন কাজের প্রতি ঝুঁকছে গ্রামাঞ্চলের নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা বলছেন দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে তারা লেখাপড়া করতে চায় না। অযথা বাড়িতে বসিয়ে রাখার চাইতে কাজ করা ভালো। এতে সংসারে কিছুটা সহযোগিতা হয়। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর বেশিরভাগ চা দোকান, গ্যারেজের কাজ, অটোরিকশা চালানো এবং মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কাজে নেমে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে কৃষি শ্রমিক, হোটেল শ্রমিকের কাজও করছে অনেকে।

অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতি নামমাত্র:
সরকার অনলাইন ক্লাস নিয়ে গুরুত্বারোপ করলেও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তেমনটা নেই। শিক্ষকরা অনেকবার বলে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়েও তাদের অনলাইন ক্লাসে আনতে পারছেন না। দারিদ্রতার কারণে অনেকের কাছে অনলাইন ক্লাস করার সরঞ্জামই নেই।

ফেনী সদর উপজেলার দমদমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফেরদৌস আরা শাহীন বলেন, অনলাইন ক্লাসে অধিকাংশ বাচ্চা অংশ নিতে পারে না। কারণ সবার বাবার স্মার্ট ফোন নেই। যাদের আছে তারা সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট চালায়। কারণ বেশিরভাগই অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। আর গ্রামে সাধারণত ওয়াইফাই থাকে না। কাজেই এতে শুধু বিত্তবানদের সন্তানেরাই শতভাগ উপকৃত হচ্ছে।

ফেনীর ফাজিলপুরের সওদাগর বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ফখরুল ইসলাম জানান, অনেক কষ্টে অনলাইন ক্লাসে চার থেকে পাঁচ জন শিক্ষার্থী আনা সম্ভব হয়। বাকিদের কোনভাবেই উপস্থিত করানো যায় না। উপস্থিতির হার থাকে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ।

শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ:
২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশে প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসে। সরকার বেশ কয়েক দফায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে বিবেচনা করলেও দেশে মহামারি পরিস্থিতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। বরং দফায় দফায় বন্ধ থাকার মেয়াদ বেড়েছে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় উপকূল, চরাঞ্চলসহ গ্রামীণ জনপদগুলোতে এভাবেই স্কুল বিমুখ হয়ে উপার্জনের দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা। স্কুল খুললেও এসব শিক্ষার্থীদের আর স্কুলে ফেরানো যাবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে বিস্তর শঙ্কা।  

ফেনী সদর উপজেলার দমদমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফেরদৌস আরা শাহীন বলেন, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ স্কুলের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানতে ওরা অনভ্যস্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ অভ্যাসটা ছুটে গেছে। ওরা হয়ত দীর্ঘ সময় শ্রেণিকক্ষে বসতে চাইবে না।

শিক্ষকরা বলছেন মাদ্রাসাগুলো আইন অমান্য করে খোলা থাকায় অনেকেই সেখানে চলে গেছে। আবার অনেকে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কাজে। এসব শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো সহজ হবে না।

ঝরে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজন উদ্যোগ:
শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন করোনার এ সময়টায় অবস্থা সম্পন্ন এবং গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যাদের বাবা-মা অনলাইন ক্লাসের সরঞ্জাম কিনে দিতে পেরেছেন তারা অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্টসহ আনুষাঙ্গিক কাজ করতে পেরেছে। যারা দরিদ্র তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে।

করোনার এই দীর্ঘসময়ে বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)।  

মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যত বেশি সময় শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে সহিংসতা, শিশু শ্রম ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকির কারণে তাদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা তত কমে যাবে। সংস্থাটি দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তার জন্য বিস্তৃত পরিসরে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দীর্ঘ সময় সরাসরি পাঠদান বন্ধ থাকলে পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার ওপর ‘অত্যন্ত গুরুতর প্রভাব ফেলে’ বলেও সতর্ক করেছেন সংস্থাটি।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া প্রসঙ্গে কথা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রফেসর ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহর সঙ্গে।  

তিনি বলেন, করোনার এ সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হয়েছে। উইথআউট বর্ডার ধারণার ক্লাস করতে গিয়ে গরিব বাচ্চারা বঞ্চিত হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার বাইরে চলে গেছে। এদের স্কুলে ফেরাতে সরকার আর্থিক সহায়তার বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে।  যেগুলো শিক্ষার্থীদের স্কুলগামী করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০২১
এসএইচডি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।