ঢাকা, শনিবার, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযোদ্ধার দুঃখগাঁথা

‘মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাইনি, আজীবন থাকবে মনের এই ক্ষত’

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১
‘মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাইনি, আজীবন থাকবে মনের এই ক্ষত’

কক্সবাজার: স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি রণাঙ্গনের যোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম কবির। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রামু থানায় ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়।

ওই মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় ৫ নম্বরে ছিল তার নাম। এ ছাড়াও তার নানা কর্ম তৎপরতার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত তৎকালীন ইউপি সদস্য গোলাম কবির। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি-বেসরকারি নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন বহুবার।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মেরংলোয়া গ্রামের মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে গোলাম কবির আক্ষেপ করে বলেন ,  দেশের জন্য এতো কিছু করেছি, ওই সময় মৃত্যুও হতে পারতো। এমনকি এ দেশ স্বাধীন না হলে পাকিস্তান আমলে যে রাস্ট্রদ্রোহ মামলাটি করা হয়েছিল সে মামলায় আমিসহ অনেকের ফাঁসিও হতো। কিন্তু সবকিছু সহায় ছিল বলে দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরাও বেঁচে গেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেলাম না। হয়তো মনের এ ক্ষত আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

প্রথম দিকে সরকারি স্বীকৃতির জন্য কোনো চেষ্টা তদবির করিনি, তবে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে অংশ নিয়েছিলাম। শুনেছি আমাদের তালিকা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে। প্রায় চার বছর হয়েছে, কোনো খবর নাই। তবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্থানীয়ভাবে যথেষ্ট সম্মান পেয়ে আসছি- বলেন গোলাম কবির।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরে লড়াই করেন গোলম কবির। তিনি বলেন, তখন আমার বয়স ছিল ২৬ বছর। বঙ্গবন্ধু কোথাও এসেছে খবর পেলেই ছুটে যেতাম সেখানে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আছে। মুক্তিযুদ্ধে আসাও ওনার কারণে। মূলত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে, শত্রুর মোবাবিলায় তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। আমার ঘরে একটা লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল, সেদিন সেটা নিয়ে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।

যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে গোলাম কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আমরা রামু খিজারী হাই স্কুল মাঠে ট্রেনিং শুরু করি। কিছুদিন পর আমরা স্থান পরিবর্তন নাইক্ষ্যংছড়ি জুমখোলা পাহাড়ে চলে যাই। সেখানে প্রায় এক সপ্তাহ ট্রেনিং করি। প্রথমে আনসার কমান্ডার আবদুল হক ও পরে সুবেদার নুর আহমদ আমাদের ট্রেনিং দেন। নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন এমপি ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী।

তিনি বলেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ সকালের ঘটনা। শত্রু বাহিনীর বিমান যেন  নামতে না পারে সেজন্য আমরা কক্সবাজার বিমান বন্দরের রানওয়ে নষ্ট করি। সেখান থেকে ফেরার পথে খবর পাই পাকবাহিনীর একটি গাড়ি (জিপ) চট্টগ্রামের লোহাগাড়া পার হয়ে কক্সবাজারের দিকে আসছে। দুপুরের দিকে আমরা আরাকান সড়কের রামু চৌমুহনী স্টেশনে রামু খিজারী হাই স্কুলের সামনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করি।

বিকেল ৩টার দিকে একটি খোলা জিপ রামু চৌমুহনীতে পৌঁছালে, আমরা সেটি আটকাই। এ সময় গাড়িতে সাদা হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা চারজন ছিলেন। আমরা ছিলাম ২০/২৫ জন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই, আমি লাফ দিয়ে জিপের ইঞ্জিনের ওপরে ওঠে, গাড়ির সামনের সিটে বসা লোকটিকে অস্ত্র তাক করি। কিন্তু তারা নিজেদের জয় বাংলার লোক বলে পরিচয় দেন। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী ঘটনাস্থলে আসেন। পরিচয় পত্র দেখে আমরা নিশ্চিত হলাম, সামনের সিটে বসা লোকটি ছিলেন, জিয়াউর রহমান। আর গাড়ি চালাচ্ছেন কর্নেল অলি আহমদ, পিছনের সিটে ছিলেন, ব্রিগেডিয়ার খালেকুজ্জামান ও কর্নেল মীর শওকত। পরে অবশ্য ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী তাদেরকে কক্সবাজার শহর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন।

যুদ্ধদিনের এরকম আরও নানা গল্প বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন এ যোদ্ধা।   তিনি বলেন, খুব সম্ভবত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে হবে, নাইক্ষ্যংছড়ি জুমখোলা এলাকায় একটি কাঠের ব্রিজের পাশে একদল রাজাকার অবস্থান নিয়েছে- এমন খবর পেয়ে সুবেদার নুর আহমদের নেতৃত্বে প্রফেসর গোলাম কাদের, আবদুল জব্বারসহ আমরা মুক্তিবাহিনীর ২০/২৫ জন সদস্য সেখানে পৌঁছে তাদের ওপর হামলা করি। এক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী পালিয়ে যায়। একই ঘটনা ঘটেছিল রামুর জোয়ারিয়ানালা লাল ব্রিজে। রাজাকার বাহিনী সেটি পাহারা দিচ্ছিলো। খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে, তারা পালিয়ে যায়।

৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাস্ট্রদ্রোহ মামলা: গোলাম কবির জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ মে তিনিসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রামু থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। মামলায় এজাহার ভুক্ত ৩৫ জনসহ অজ্ঞাত আরও ২৫/৩০ জনকে আসামি করা হয়। ১ নম্বরে ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, ২ নম্বরে প্রফেসর মোশতাক আহমদ, ৩ নম্বরে আফসার কামাল চৌধুরী, ৪ নম্বরে আকতার আহমদ, ৫নং নম্বরে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, এ পাঁচজনের মধ্যে বর্তমানে আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এ পর্যন্ত এ পাঁচজনের একজনও  সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাননি।

শুধু দেশের জন্য নয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্যও নিবেদিত প্রাণ ছিলেন গোলাম কবির। ১৯৬৫ সালে রামু খিজারী হাই স্কুলে অস্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সে সময়ই তিনি রামু উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি রামু থানা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, এরপর যুবলীগ গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে তিনি রামু থানা যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। একই সময়ে রামু থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

সে সময়ের সহযোদ্ধা ও রামু উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য বিদায়ী কমান্ডার নুরুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে গিয়ে গোলাম কবির রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়েছেন। এ ছাড়াও যুদ্ধকালীন সময়ে তার অবদানের কথা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা সবাই অবগত। কিন্তু কী কারণে এতোদিন পর্যন্ত সরকারি তালিকায় তার নাম আসেনি, আমার বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাইয়ে তার নাম আমরা পাঠিয়েছি। কিন্তু এটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

রামু উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, যাচাই-বাচাই শেষ করে ২০১৭ সালে একটি তালিকা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তিতে সেই তালিকা থেকে তিন জনের নাম (১০ ভাগ) আমরা পুনরায় পাঠিয়েছিলাম। বাকিদের নামও তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

বাংলাদেশ সময়- ১৯২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮.২০২১
এসবি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।