লালমনিরহাট: সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় ভাতা বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সেই অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন থাকছে বাংলানিউজে।
জানা গেছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্পের মাধ্যমে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা দিচ্ছে সরকার। শুরুতে মাসিক ভাতার এ টাকা সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হলেও সাম্প্রতি ভোগান্তি এড়াতে অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অনলাইনের সুযোগে সুফলভোগীর নম্বরের পরিবর্তে আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সদ্য বদলিকৃত কারিগরি প্রশিক্ষক রাকিবুল হাসান তার বাবার বিকাশ নম্বর দিয়ে টাকা আত্নসাৎ করেন।
রাকিবুল হাসান এ উপজেলায় যোগ দেওয়ার পর থেকে নানান কৌশলে ভাতাভোগীদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তিনি উপজেলার পলাশী ইউনিয়নে নামে, বে-নামে ভাতাভুক্ত করে টাকা উঠিয়ে আত্মসাত করেন। একই ব্যাক্তির নামে একাধিক ভাতার ব্যবস্থা করে অতিরিক্ত টাকা নিজেই আত্নসাত করেছেন। তার ইউনিয়নের অনেকেই দুই বছর আগে ভাতার জন্য মনোনীত হলেও টাকা পাননি বলে অভিযোগ মিলেছে।
গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পলাশী ইউনিয়নের দেওডোবা গ্রামের জব্বারের মেয়ে এক খোদেজা বেগমের নামেই দুটি বিধবা ভাতার বই তৈরি করেন রাকিবুল হাসান। যার একটি রাকাব নামুড়ি শাখার হিসাব নম্বর ১০৯৮ ও অপরটি ১১০২। চলতি বছরের ২৯ মার্চ দুই হিসাব নম্বরে টাকা উত্তোলন করা হয়। যার একটির টাকা সুফলভোগী পেলেও অপরটি নিজে আত্মসাত করেন রাকিবুল। একই অর্থ বছরে ওই গ্রামের মৃত গনেশের স্ত্রী কৃষ্ণরানী সিংয়ের নামে বিধবা ভাতা এবং গনেশের বোন প্রতিবন্ধী ললিতা রানীর নামে প্রতিবন্ধী ভাতা চূড়ান্ত হয়। এরপর ব্যাংক থেকে সেই ভাতার টাকা উত্তোলন করা হলেও সুফলভোগীরা দুই বছরেও তা পানিনি। সম্প্রতি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন কৃষ্ণরানী ও ললিতা রানী। এছাড়াও রাকিবুল হাসানের বিরুদ্ধে এমন কয়েক ডজন অভিযোগ সমাজসেবা অফিসে জমা পড়েছে।
এমন দুর্নীতি বন্ধে সরকার অনলাইনে ভাতা প্রদানের উদ্যোগ নিলে সেখানেও কৌশল অবলম্বন করেন রাকিবুল হাসান। এক্ষেত্রে তিনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে সিম উত্তোলন করে সুফলভোগীদের বিকাশ নম্বরের পরিবর্তে নিজের নম্বরগুলো দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এসব নম্বরে টাকা উত্তোলন করে সিম খুলে রাখেন তিনি। ফলে সহজে কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারছেন না।
পলাশী ইউনিয়নের তালুক পলাশী গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে প্রতিবন্ধী মানিক মিয়ার নম্বরের পরিবর্তে রাকিবুল হাসান তার বাবা সহিদার রহমানের ০১৭২৩৩৩১১৮৭ নম্বর সংযুক্ত করেন। ভাতাভোগীদের পাসবুক অনুযায়ী মানিক মিয়ার প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা গত ২৫ জুন বিকেল ৪টা ৪২ মিনিট ১১সেকেন্ডে ৬ হাজার ৭৯৭.২৫ টাকা পরিশোধ হয়েছে সহিদার রহমানের উক্ত নম্বরে। তবে নম্বরটি নিজের বলে স্বীকার করে সহিদার রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সেটি বিকাশ করা নেই এবং কোনো টাকা আসেনি। কারিগরি প্রশিক্ষক রাকিবুল হাসান তার ছেলে বলেও জানান তিনি।
অপরদিকে প্রতিবন্ধী মানিক মিয়া বলেন, প্রশিক্ষক রাকিবুল বিকাশ নম্বর নিয়েছেন। কিন্তু আজও টাকা পাইনি। কয়েকদিন তার অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে হাতীবান্ধা যাওয়ায় আর খোঁজ নিতে পারিনি। আমার মতো গরিবের টাকা আত্মসাৎ করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এমন অবস্থা পলাশী ইউনিয়নের শতাধিক সুফলভোগীর।
এতেও থেমে থাকেননি কারিগরি প্রশিক্ষক রাকিবুল। বিগত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্ধের এক লাখ ৮০ হাজার টাকা সোনালী ব্যাংক আদিতমারী শাখা থেকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসারের স্বাক্ষর জাল করে উঠিয়ে আত্মসাৎ করেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় আইনগত ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের জোরালো সুপারিশে সেই টাকা সমুলে ব্যাংকে ফেরত দিয়ে বেঁচে যান রাকিবুল।
এতোসব অনিয়মের কারণে সম্প্রতি তাকে আদিতমারী থেকে হাতীবান্ধা উপজেলায় বদলি করা হয়। যা ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন রাকিবুল। তিনি বদলি হলেও সুফলভোগীরা আজও পাচ্ছেন না সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া তাদের ন্যায্য ভাতা। এসব অনীয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরির মাত্র ৫ বছরে বাড়ি গাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে রাকিবুলের বিরুদ্ধে।
তবে, এ বিষয়ে রাকিবুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ওই প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী বিকাশ নম্বর দিতে বিলম্ব করায় আমার বাবার মোবাইল নম্বর দিয়েছি। কিন্তু বাবার নম্বরটি বিকাশ করা নেই, তাই টাকাও উত্তোলন করা হয়নি। স্বাক্ষর জালের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার রওশন আলী মন্ডল বাংলানিউজকে বলেন, সদ্য বদলিকৃত প্রশিক্ষক রাকিবুল হাসানের বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। নাম থাকার পরেও ভাতার টাকা না পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। রাকিবুলের বাবার মোবাইলে প্রতিবন্ধীর টাকা যাওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না। সব বিষয় খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২১
এমএমজেড