ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

নারীপাচার

চাকরির কথা বলে কুয়েতে নিয়ে পতিতাবৃত্তিতে বিক্রি 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১
চাকরির কথা বলে কুয়েতে নিয়ে পতিতাবৃত্তিতে বিক্রি 

ঢাকা: ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন লিটন মিয়া। অনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে চাকরিচ্যুত হয়ে চলে যান ইরাকে।

আর সেখানে গিয়ে নিজেকে ডা. লিটন বলে পরিচয় দিয়ে গড়ে তোলেন মানবপাচারের একটি চক্র। চক্রটি মূলত বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের টার্গেট করতো। ইরাকের বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরি কিংবা বিয়ের প্রলোভন দিয়ে নারীদের নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হতো পতিতাবৃত্তিতে। এছাড়া তরুণদের অন্যান্য চাকরির প্রলোভন দিয়ে ইরাকে নিয়ে আটকে রেখে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হতো।

ইরাক থেকে পালিয়ে দেশে আসা দুইজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে মানবপাচার চক্রের মূলহোতা লিটন মিয়া ওরফে ডা. লিটন (৪৪) ও তার সহযোগী আজাদ রহমান খানকে (৬৫) আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৪)।

শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট, জালটাকা, চেকবই, ইয়াবা, বিয়ার ও একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়।

র‌্যাব জানায়, চক্রটি ইতোমধ্যে ২০০-২৫০ জন মানুষকে ইরাকে পাচার করেছে, এর মধ্যে ৩০-৩৫ জন নারী রয়েছেন। তারা টার্গেট করা ব্যক্তিদের তিন লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে ভিজিট ভিসায় ইরাকে নিয়ে আটকে রাখা হয় নিজেদের কথিত সেফ হাউজে। তরুণদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হতো। আর নারীদের ১৩-১৫ হাজার দেরহামের বিনিময়ে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো।

মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে ডা. লিটন

১৯৯২ সালে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন লিটন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এরপর অনৈতিক কাজের দায়ে তাকে ২০১০ সালে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৩ সালে ইরাকে গিয়ে সবার কাছে নিজেকে ডা. লিটন বলে পরিচয় দিতে থাকেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বাগদাদের একটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন বলে প্রচার করতেন। আর নারীদের টার্গেট করে বাগদাদে চাকরির প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যেতেন তিনি।

টার্গেট নার্সদের

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সদের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। আর লিটন যেহেতু আগে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন তার এই সেক্টরের বিষয়ে ধারনা ছিলো। এজন্য পাচারের জন্য তিনি নার্সদের টার্গেট করতেন। যেসব নার্সদের বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা থাকতো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সখ্যতা গড়ে তুলতেন। ইরাকের স্বনামধন্য হাসপাতালেমোটা বেতনে চাকরির প্রলোভন, আবার কখনো নিজে বিয়ে করবেন বলে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর সেখানে আটকে রেখে সুবিধামতো সময়ে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এর বাইরে অন্যান্য নারীদের বিভিন্ন সুপারশপ, বিউটি পার্লারে চাকরির কথা বলেও পাচার করা হতো।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অন্তত ৬টি বিয়ে করা লিটন নিজেকে অবিবাহিত বলে পরিচয় দিতেন। বেশিরভাগ বিয়েগুলোই করেছেন টেলিফোনে। নারীদেরকে বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে ইরাকে নিয়ে যেতেন। যে ৬ জনকে বিয়ে করেছেন এর মধ্যে ৫ জনকেই পাচার করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এই মানবপাচার চক্রের মূলহোতা লিটন। এছাড়া দেশে এইনচক্রে ১০-১৫ জন এবং ইরাকে আরো ৫-৭ জন রয়েছে বলে জানা গেছে। ইরাকে তাদেন ৬-৭টি সেফহাউজ রয়েছে, যেখানে পাচারকৃতদের নিয়ে আটকে রাখা হতো।

ভুক্তভোগী দুইজনের বরাত দিয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, দুইজনের মধ্যে একজনকে বিয়ে করে আরেকজনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৯ সালে ইরাকে নিয়ে যায় লিটন। এর মধ্যে একজন গিয়ে একটি সেফ হাউজে ৪০-৫০ জনকে দেখেছেন। যেখানে ১৫-২০ জন নারী রয়েছেন। একজন কৌশলে পালিয়ে গিয়ে একটি হাসপাতালে তিনমাস চাকরি করেন। এরপর দেশে ফিরে আসেন তিনি। আরেকজনকে মোট তিনবার বিভিন্ন দালালের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ যার কাছে বিক্রি করা হযেছিলো তার সহায়তায় তিনি প্রায় দুই বছর পর দেশে ফিরেন। মানবপাচারের দায়ে লিটন দুইবার ইরাকে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। এরপর পালিয়ে ২০১৯ সালেই দেশে ফিরে আর যাননি। দেশে এসে তিনি বালুর ব্যবসাসহ অন্যান্য কাজ করছিলেন। দেশে তার নামে ৬-৭টি মামলা থাকলেও এই প্রথমবার তিনি আটক হলেন।

ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে মানবপাচারে আজাদ

আজাদ ১৯৯৩ সাল থেকে বিদেশে মানবসম্পদ রপ্তানির কাজ করছেন। তিনি এখন পর্যন্ত ২৫-৩০ হাজার লোক বিদেশে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। লিটনের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে ২০১৬ সাল থেকে তিনি চাকরির প্রলোভনে অন্তত ২০০-২৫০ জনকে পাচার করে দেন।

পাচারকৃতদের কাউকেই সে চাকরি দিতে পারেনি। উল্টো সেখানে নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হতো। দেশ থেকে ভুক্তভোগীদের স্বজনরা সেসব অর্থ আজাদের কাছে দিতেন। এছাড়া মানবপাচার প্রক্রিয়ার জন্য ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন, ভিসার ব্যবস্থা, টিকিট কাটাসহ সব ধরনের কাজ করতেন আজাদ।

যা বলছেন ভুক্তভোগীরা

কুয়েত থেকে তিন মাস পর পালিয়ে আসা এক ভুক্তভোগী তরুণী বলেন, একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আমি সিভি জমা দেই। তারপর ডাক্তার পরিচয় দিয়ে লিটন আমাকে ফোন করে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান, বিয়ে করে কুয়েতে নিয়ে যাবে এবং সেখানে নিয়ে হাসপাতালে চাকরি দেবে বলে জানায়।

পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে আমাকে বিয়ে করে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতে নিয়ে যান লিটন। আর আমার সব কাগজপত্র প্রসেসিং করেন আজাদ। কুয়েতে যাওয়ার পর দেখি তিনি ডাক্তার না। সে কি করছে দেখতে চাইলে আমাকে তার অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে ৫০-৬০ জনকে দেখি, এদের মধ্যে ১০-১৫ জন মেয়েও ছিলো। তখন লিটন বলে এদের সবাইকে আমি এনেছি, তাদেরকে কাজ দেবো এখানে।

বিষয়টি সন্দেহ হওয়ায় একদিন লিটন বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমি পাসপোর্ট নিয়ে বের হয়ে যাই। বাগদাদের একটি হাসপাতালে তিনমাস চাকরি করে আমি দেশে ফিরে আসি। করোনার কারণে অনেকদিন কোন পদক্ষেপ না নিলেও একপর্যায়ে আমি র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করি। আমার একটাই চাওয়া তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমি ঢাকায় একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছিলাম। একপর্যায়ে লিটনের মাধ্যমে যোগাযোগের পর চাকরির কথা বলে ২০১৮ সালের শেষের দিকে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভালো সেলারি, কম কাজ এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নানান সুবিধার কথা বলা হয়েছিলো। আমরা একসঙ্গে ৪-৫ জন মেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে নিয়ে আমাকে একটি বাসায় রাখা হয় যেখানে আরো ৭-৮ জন মেয়ে ছিলো। এছাড়া আরো ৩০-৩৫ জনকে দেখেছি। একপর্যায়ে লিটনের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়া সে আমাকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে এক এক করে আমাকে চারজনের কাছে বিক্রি করে লিটন। সর্বশেষ যার কাছে বিক্রি করে সে তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলো আমাকে। তার সহায়তায় আমি ওখানকার একটি হাসপাতালে চাকরি করে তার টাকা ফেরত দিয়ে দেশে ফিরে আসি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১
পিএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।